‘মুক্তিযুদ্ধ’ মাত্র ৪ টি বর্ন বা ৬ টি অক্ষরের ছোট একটি শব্দ । কিন্তু এর রয়েছে তলহীন গভীরতা । ৯ মাস ব্যাপি একটি ছোট যুদ্ধ জন্ম দিয়ে গেছে হৃদয় বিদারক সহস্র গল্প । সৃষ্টি করে গেছে ততকালিন প্রতিটি মানষের মধ্যে অদম্য বেঁচে থাকার শক্তি, সাহস আর স্পৃহা । আচমকা ২৫ শে মার্চ, কালোরাত্রির সে ভয়াবহতার পর হঠাৎ ঘুমন্ত বাঙালি সবাই যেন একসাথে জেগে উঠে । সবার বুকে সঞ্চার হয় এক আশ্চর্য রকম সাহস । বিশাল পাকিস্তানী বাহিনীর উপর নিরস্ত্র আর কম সংখ্যক জনবল নিয়েও ঝাপিয়ে পরে সমতালে ।
মুক্তিযুদ্ধের কথা আসলেই আমাদের মনে পরে বঙ্গবন্ধুর কথা । সে সাথে আমরা জয়গান গাই জাতীয় চার নেতা, যুদ্ধে অংশগ্রহনকারী সসস্ত্রবাহীনি, গেরিলা যোদ্ধা, শব্দ সৈনিক আর বীরাঙ্গনাদের । অথচ আমাদের দেশে মুক্তিযুদ্ধে নারীরা ও অংশগ্রহণ করেছেন সক্রিয়ভাবে । মুক্তিযুদ্ধে নারীদের ভূমিকা কেবল রণক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ ছিলো না । তাদের বিসৃতি ছিলো ঘরে বাহিরে সমহারে। বাংলার স্বাধীনতা মানেই কেবল ৩০ লাখ শহিদ আর ২ লাখ বীরাঙ্গনা না । বাংলার মুক্তিযুদ্ধে করেছেন তারাও, যারা নিজের মুখের অন্য তুলে দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের মুখে । যুদ্ধ করেছেন সে মা, নাড়ি ছেড়া ধনকে যিনি সগ্রাহে পাঠিয়েছেন দেশ রক্ষা করতে । যুদ্ধ করেছে সে নববধুও, যিনি মেহদি রাঙা হাত নিয়েই পরে নিয়েছেন বিধবার সাদা শাড়ি ।
একথা যেন আমরা ভুলতেই বসেছি, যুদ্ধের সময় বাঙালি নারীরা আমাদের অনেক বড় সহায় শক্তি ছিল । নারীরা কখনো সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে অংশ নিয়েছেন আবার কখনো যুদ্ধক্ষেত্রের আড়ালে থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছেন । দুঃসাহসী নারীরা দেশের স্বাধীনতার জন্য সাহায্য করে গেছেন নিরন্তর । অনেক নারী আছেন যারা কখনো মায়ের মতো, কখনোবা বোনের মতো মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস জুগিয়েছেন, প্রেরণা জুগিয়েছেন, সেবা করেছেন ।
নিজে না খেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটিতে খাবার রান্না করে পাঠিয়েছেন এমন নারীর সংখ্যাও নেহাত কম না । যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদারের হাত থেকে রক্ষা করতে নিজেদের জীবনের পরোয়া না করে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের ঘরে আশ্রয় দিয়েছেন । তারা কাজ করেছেন ক্যাম্পে ক্যাম্পে । নারীরা অনেক সময় খানসেনা আর রাজাকারদের অবস্থান সম্পর্কেও খবর জানিয়েছেন । বিভিন্ন জায়গায় গোপনে অস্ত্র পৌঁছে দেওয়া, যুদ্ধাহতদের সেবা ও চিকিৎসা করা , প্রয়োজনীয় ঔষধ, কাপড় সরবরাহ সহ গুরুত্বপূর্ন কাজগুলোর ভার হাসিমুখে বাংলার নারীরা তাদের কাঁধে তুলে নিয়েছেন ।
প্রীতিরানী দাস পুরকায়স্থ, শুক্লা রানী দে, হেমলতা দেব ছাড়াও আরো অনেকেই উল্লেখযোগ্য ভুমিকা রেখেছেন প্রাথমিক চিকিৎসায় । এগুলো কথা আমরা হয়তো জানি । কিন্তু এমন আরো কত কাহিনী আছে যা রয়ে গেছে লোকচক্ষুর ।
কুষ্টিয়া রণাঙ্গনে অনন্য ভূমিকা রেখেছে নাজিয়া ওসমান চৌধুরী । সেলিনা বানু সশরীরে উপস্থিত হয়ে যোদ্ধাদের মনোবল অটুট রাখছেন, জাগিয়েছেন শরণার্থীদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা । তাছাড়া যুদ্ধ চলাকালে অনেক নারী কবি, লেখক, সাংবাদিক তাদের উদ্দামী লেখা নিয়ে এগিয়ে এসেছেন দেশ স্বাধীন করার কাজে ।
এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের মায়েদের কথাও বলা দরকার। শহীদ রুমীর মা জাহানারা ইমাম কিংবা শহীদ আজাদের মা সাফিয়া বেগমের মতো সব মায়েরা মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের অনুপ্রেরণা দিয়ে গেছেন । এ মায়েরা সন্তানের মনে জাগিয়েছেন দেশের প্রতি ভালবাসা । তারা সন্তানদের শিখিয়েছেন দেশটাও তাদের মা । তাইতো সন্তানরাও মাকে বাঁচাতে ঘর ছাড়া হয়েছে । তাদের মধ্যে কেউ গর্ভধারীনের কোলে ফেরত এসেছিল, আবার কেউ মিশে গেছে দেশমাতার মাটির সাথে ।
মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭২ সালে ১ লখ ৭৫ হাজার (প্রায়) মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সর্বমোট ৬৭৬ বীর যোদ্ধাকে ভূষিত করা হয় বীরশ্রেষ্ঠ, বীর উত্তম, বীর বিক্রম এবং বীর প্রতীক খেতাবে । তাদের মধ্যে তিনজন নারীও রয়েছেন । ডা. সেতারা বেগম ,তারামন বিবি এবং কাঁকন বিবি । তাদের বিরত্বের জন্য ‘বীরপ্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করা হয় ।
যারা সরাসরি যুদ্ধ করেছেন তাদের প্রাণ নাশের আশঙ্কা ছিলো সব থেকে বেশি । তবে উল্লেখিত নারি কর্মকান্ড কোনটা বাধাগ্রস্থ হলে মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিক প্রবাহ ভেঙে পরতো । প্রতোক্ষ কিংবা পরক্ষ যেভাবেই হোক না কেন , নারীদের যে কোন ভূমিকায় কাজ করাটাও ছিল মারাত্বক ঝুঁকিপূর্ন । শত বিপদ উপেক্ষা করে নারীদের যোগানো মদোত ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধতে একটি শক্তিশালি মাত্রা যোগ করেছিলো । যার কারনে আমরা পেয়েছি বহুল আকাঙ্খিত বিজয়ের লাল সবুজ পতাকা । আজ আমরা বিশ্ব মানচিত্রে অবস্থান পেয়েছে আর পেয়েছি জাতিগত সম্মান । নারীদের এই সাহসী পদক্ষেপ আর অনুপ্রেরণাই ছিল স্বাধীনতার অন্যতম মূলমন্ত্র ।
ফাতেমা তুজ জান্নাত মৌ
কবি, কথা সাহিত্যিক ও ঔপন্যাসিক