Can't found in the image content. ঢাবির সান্ধ্য আইন কী নারী শিক্ষার্থীদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে? | ফ্রিডম বাংলা নিউজ
ফ্রিডম বাংলা নিউজ

শনিবার, ডিসেম্বর ২১, ২০২৪ |

EN

ঢাবির সান্ধ্য আইন কী নারী শিক্ষার্থীদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে?

কলাম ডেস্ক | আপডেট: বুধবার, মে ৮, ২০২৪

ঢাবির সান্ধ্য আইন কী নারী শিক্ষার্থীদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) নারী শিক্ষার্থীদের হল রাত ১০টায় বন্ধ হয়ে যায়। এ বিষয়ে সকলেই জানে। তবে সম্প্রতি সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের দেয়ালে একটি লেখা চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। লেখাটি কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের কিনা এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

"দশটার মধ্যেই মেয়েদের হলে ঢোকার সামন্তবাদী প্রথা উচ্ছেদ করুন" - এমনটাই লেখা ছিল। এ লেখার ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেইসবুকে পোস্ট করলে কমেন্ট সেকশনে বের হয়ে আসে অজানা অনেক তথ্য। 

ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী পুষ্পিতা পালের মতে, যারা কখনই বিপদে পড়েনি তারা রাত ১০টার পরে হলে প্রবেশের চেষ্টা করার সময় যে অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয় তা বুঝতে পারবে না।

পিতৃতন্ত্রের নিপীড়নমূলক প্রকৃতি এবং এর প্রয়োগকারীরা এমন নিয়মের পক্ষে অবস্থান করে। ছেলেরা এমন কোনও নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হয় না।  রাত ১০টার পরে ছেলেদের কার্যকলাপ সম্পর্কে একইভাবে যাচাই-বাছাই করা হয় না। অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী আশেক মাহমুদ এই মত দেন। 

বহুদূর থেকে এসেও তার এক বান্ধবীর মা নিজ মেয়ের সাথে দেখা করতে পারেননি। কারণ তার পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত সাড়ে দশটা বেজে যায়। ঘটনাটি জেনে মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে 'বিশ্ববিদ্যালয়ের হল কি বন্দী রাখার জায়গা কাশিমপুর কারাগারের সাথে তুলনীয়?'

সারা রাত হলের বাইরে থাকার অনুমতি থাকলেও মাত্র দশ মিনিট দেরি করলে হলে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। কেউ কেউ এমন নিয়মের সুযোগ নেয়। কিন্তু অনেক মেয়ের উপরেই রাত ১০টায় গেট বন্ধ করে দেওয়ার জন্য বিরূপ প্রভাব পড়ে। ট্রেন কমলাপুর স্টেশনে পৌঁছাতে বিলম্ব করতে পারে। এজন্য দেরি হলে গেটের বাইরে আটকা পড়ার ঝুঁকি রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের মাঝে মাঝে স্থানীয় অভিভাবকের বাড়িতে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু ঢাকায় রাতে কারো বাড়িতে পৌঁছানোটা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। তাছাড়াও এমন অনেক শিক্ষার্থী রয়েছে যাদের ঢাকায় কোনো স্থানীয় অভিভাবকই নেই। 

অনেকেরই অভিযোগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টোরিয়াল টিম তাদের কাজে তৎপরতা দেখায় না। এতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সব সময় একটা আতঙ্ক থেকেই যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা ও প্রক্টোরিয়াল টিমের জন্য বাজেট বরাদ্দ করা হয়। তাই কিছু শিক্ষার্থী মনে করেন, রাত দশটার ভিতরে হলে প্রবেশ করার বাধ্যবাধকতার মানে মেয়েদের মৌলিক স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করা। এমনকি জরুরী অবস্থার জন্য হল ছেড়ে যাওয়ার চেষ্টা করার সময়ও তারা বাধার সম্মুখীন হয় এমন অভিযোগও রয়েছে।  
 
তবে বেশ কয়েকজন নারী শিক্ষার্থীও হল রাত দশটার ভিতরে বন্ধ করার স্বপক্ষে মত প্রকাশ করেন। তাদের মতে নিজ বাড়িতেই কখনো সন্ধ্যার পর বাইরে থাকা যায় না। তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ে কীভাবে রাত দশটার পরও হলের বাইরে থাকার চিন্তা করা যায়? এছাড়াও রাতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানভিত্তিক মাদকের কারবার ও মাদক সেবন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ত্রাস নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অনেকে। তবে কেউ কেউ জানান বিশেষ অনুরোধ করলে কয়েকটি হলের কর্তৃপক্ষ নিয়মে কিছুটা শিথিলতা দেয়। তবে সে সুযোগ মাসে একবারই পাওয়া যায়।

এছাড়াও শিক্ষার্থীরা জানান, নিয়ম উপযুক্ত হলেও বাস্তবায়নে সংশোধন করা উচিত।  জরুরী অবস্থার কারণে বা বাড়ি থেকে ফিরতে দেরী করলে হলে প্রবেশ করতে দেওয়া উচিত। এছাড়াও, সকল শিক্ষার্থীর মেয়েদের হলের মধ্যে চলাফেরা করার, ক্যান্টিনে খাবার খাওয়া এবং কমন রুমে বিশ্রাম নেওয়ার স্বাধীনতা থাকা উচিত। মেয়েদের হলে পুরুষ শিক্ষার্থীদের দৈনন্দিন প্রবেশ নিষিদ্ধ করা অযৌক্তিক বলে মনে করেন তারা। 

অনেকে জানিয়েছেন ছেলে এবং মেয়ে উভয়ের হল একটি নির্দিষ্ট সময় বন্ধ করা উচিত। রাতে ছেলেদের হল উন্মুক্ত থাকবে আর মেয়েদের হল বন্ধ থাকবে এটা অনেকে মেনে নিতে পারছেন না। তারা এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে সমঅধিকারের কথাও তুলে ধরছেন।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী নূর-নবী নূর। তিনি গভীর রাতে তার একজন নারী শিক্ষার্থীকে সুফিয়া কামাল হলে পৌঁছে দেওয়ার একটি সাম্প্রতিক ঘটনা জানান।  গত মাসের ১৯ তারিখ ট্রেনে করে তারা রাত ১টায় ঢাকা পৌঁছান। তিনি বলেন, 'আমাদের আসতে দেরি হবে বুঝতে পেরে আপু ১০টার আগেই প্রভোস্ট ম্যাম নাকি হাউস টিউটর ম্যামকে সব জানিয়ে টিকেট আর লোকেশন শেয়ার করেন।' সৌভাগ্যবশত, হল কর্তৃপক্ষ অবস্থা বুঝতে পেরে রাত ১টায় ঐ নারী শিক্ষার্থীকে হলে প্রবেশের অনুমতি দেয়।

ঢাকা-রংপুর সড়কে দীর্ঘ যানজটের কারণে ৬ ঘন্টার যাত্রা শেষ হয় ১৪ ঘন্টায়। এভাবে রাত সাড়ে এগারোটায় রোকেয়া হলে পৌঁছান আবাসিক শিক্ষার্থী আনিকা তাহসিন হাফসা। কিন্তু হলের প্রবেশদ্বার রক্ষীরা প্রাথমিকভাবে তাকে প্রবেশ করতে দিতে রাজি হয়নি। পরবর্তীতে তার রুমমেটরা এসে অনেক অনুরোধ করে তাকে হলের ভেতর নিয়ে যান।


পীযূষ কুমার শীল নামে এক শিক্ষার্থী ছেলে ও মেয়েদের নিরাপত্তার বিষয়ে সমতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।  তিনি যুক্তি দেন যে ছেলেদের ভয় প্রাথমিকভাবে ছিনতাই এবং বস্তুগত ক্ষতির মধেই সীমাবদ্ধ। যা সময়ের সাথে সাথে পুনরুদ্ধার করা যেতে পারে।  বিপরীতে, মেয়েদের সবচেয়ে বড় ভয় হলো তাদের মর্যাদা এবং সম্ভ্রম হারানো। যা একবার হারিয়ে গেলে আর ফিরে পাওয়া যায় না।  

তিনি আরও উল্লেখ করেন, যারা ১০টার মধ্যে ফিরতে পারবেন না তাদের জন্য একটি ব্যবস্থা রয়েছে।  তারা সরাসরি তাদের অভিভাবকদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন, অনুমতি নিতে পারেন এবং পরবর্তীতে হল প্রাঙ্গনে প্রবেশ করতে পারেন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ঢামেক) মেয়েদের হল যেখানে সারারাত খোলা থাকে সেখানে ঢাবির মেয়েদের ১০ টায় হলে ঢুকতে হয়। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিভেদ প্রকাশ পায়। ধরেই নেওয়া হয় মেয়েরা দশটার পর বাইরের সুরক্ষিত না। সামাজিকভাবেও মনে করা হয় মেয়েরা বাইরে থাকলে ক্ষতির সম্মুখীন হবে। এই ধরনের মন মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। মেয়েদের হলে আটকে না রেখে ক্যাম্পাসের পরিবেশ সুষ্ঠু রাখার অনুরোধ জানান উইমেন এন্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী পরমা সরকার

জানা গেছে, অনেক নারী শিক্ষার্থী নিয়মিত নিয়ম লঙ্ঘন করেন। তারাই আবার এই সমস্যাগুলি তুলে ধরে তাদের ক্রিয়াকলাপকে ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টা করেন। হলে মেয়েদের অবাধ প্রবেশের অনুমতি দেওয়ার ইতিবাচক প্রভাব এখনো স্পষ্ট না।

জীবনের অন্যান্য দিকগুলির মতো প্রতিটি নিয়মের সুবিধা এবং অসুবিধা রয়েছে।  মাঝে মাঝে কেউ এই নিয়মগুলির জন্য সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে। তবে এটি লক্ষ করা গুরুত্বপূর্ণ যে এমনটা সবসময় হয় না। একজন নিজেকে যতই প্রগতিশীল মনে করুক না কেন সামাজিক নিয়ম এড়ানো যায় না।  আমরা একটি সমাজের মধ্যে বিদ্যমান এবং আমাদের কর্ম আমাদের চারপাশের সবাইকে প্রভাবিত করে। সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের দেয়ালে এই অনুশীলন বাদ দেওয়ার আহ্বান জানানো লেখাটি অন্তর্নিহিত অসন্তোষেরই ইঙ্গিত দেয়। 

রাত ১০টার পর ক্যাম্পাসে প্রবেশের চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকির কথা তুলে ধরেছেন শিক্ষার্থীরা। তবে এ নিয়ম সম্পর্কে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি বিদ্যমান। কেউ কেউ এর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। অনেকে নিরাপত্তা ব্যবস্থার পক্ষেও কথা বলেন। মতভিন্নতা থেকে বুঝা যায় যে এ সমস্যাটা আসলেই জটিল।

নাইমুর রহমান ইমন
৩য় বর্ষ
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ 
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়