বাংলাদেশের রাস্তায় আবার লেগেছে গার্মেন্টস শ্রমিকদের রক্তের দাগ। চারদিন আগে, গাজীপুরের কোনাবাড়ির জারুন এলাকায় এ দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি শ্রমিকরা আন্দোলন করছিল। তাদের দাবি ছিল সুরক্ষিত কর্মব্যবস্থা ও নায্য মজুরি নিশ্চিত করা। সেই আন্দোলনই প্রাণ কেড়ে নিল আঞ্জুরা খাতুন এবং জালাল উদ্দিনের।
তাদের জীবনের ঘটনা ভিন্ন হলেও তারা অভিন্ন সুতোয় গাঁথা। শান্তিপূর্ণভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রযোজ্য মজুরির দাবিতে তারা পেলো সহিংসতা। তাদের কন্ঠরোধ করতে এ রাষ্ট্র ব্যবহার করলো বুলেট, ব্যাটন আর টিয়ার গ্যাস। দুই সন্তানের জননী আঞ্জুরা ও ভগ্নহৃদয়ের স্ত্রী ও কণ্যার জালালের বিয়োজন বিবেকে নাড়া দেয়।
কী দোষ ছিল তাদের? মাসিক বেতন ২৩ হাজার দাবি করেছিলেন। এই অর্থ দিয়ে ঢাকার মতো ব্যয়বহুল শহরে কোনোমতে বাসা ভাড়া দিয়ে, খাবার কিনে আর যাতায়াত ভাড়া দিয়ে বেঁচে থাকা যায়। মৌলিক অধিকার রক্ষা করা তো আমাদের সংবিধানেই উল্লেখ রয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকেই তো এর পক্ষে বহু প্রতিশ্রুতি শোনা গেছে। কিন্তু তা আমরা পেয়েছি কী? এ দাবি যৌক্তিক এবং নায্য। এ দাবি মেনে নেওয়া নৈতিক বাধ্যবাধকতা।
দুঃখজনক হলেও সত্য, শ্রমিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটা তো একটা ভগ্নদশা রাষ্ট্রব্যবস্থার সাম্প্রতিক উদাহরণ। এ রাষ্ট্র শ্রমিকদের ফেলনা হিসেবেই দেখে। এখানে মানুষের চেয়ে মুনাফাটাই বেশি অগ্রাধিকার পায়। নিম্ন মজুরি, সংকটপূর্ণ জীবন মান আর ভিন্নমতের দমন, এই হলো লাখ-লাখ শ্রমিকের নিত্যকার বাস্তবতা। তাদের শোষণ করেই সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো লাভবান হচ্ছে।
এটা সত্য যে বহু সংগ্রামের পর মজুরি বেড়েছে। কিন্তু নয়া ঘোষিত ১২ হাজার ৫০০ টাকা শ্রমিকদের প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) জানিয়েছে ঢাকার চার সদস্যবিশিষ্ট একটি পরিবারের খাবারের জন্য খরচ হয় ২২ হাজার ৬৬৪ টাকা। খাদ্যতালিকা থেকে মাছ-মাংস বাদ দিলে খরচ বড়জোর ৭,১৩১ টাকাই কমে। এই অধিকারের জন্য শ্রমিকরা মুখ খুললে তার জবাব দেওয়া হয় অসহিষ্ণুতা ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে।
সরকারের চিত্তাকর্ষক জিডিপির সংখ্যা আর অর্থনীতির গোলাপি ছবি লাখো শ্রমিকের বর্ণহীন বাস্তবতা থেকে অনেকটাই ভিন্ন।
বাংলাদেশের গার্মেন্টস শ্রমিকরা শারীরিক সহিংসতা, যৌন হয়রানি এবং অনিরাপদ কাজের পরিস্থিতি সহ বিস্তৃত বর্বরতার শিকার হয়। এই বিমাতৃসুলভ আচরণ দায়মুক্তির সাথেই সংঘটিত হয়, কারণ শ্রমিকরা তাদের চাকরি হারানোর বা প্রতিশোধ নেওয়ার ভয়ে কথা বলতে ভয় পায়।
তাদের প্রায়ই মারধর করা হয়, লাথি দেওয়া হয় এমনকি তাদের নিয়োগকর্তারা তাদের শারীরিকভাবে নির্যাতন করে। এই সহিংসতা কর্মীদের নিয়ম লঙ্ঘনের জন্য শাস্তি দিতে, তাদের দীর্ঘ সময় কাজ করাতে বা কম মজুরির দিয়ে ভয় দেখানোর জন্য বা তাদের উপর নিয়োগকর্তার ক্ষমতা জাহির করতে ব্যবহার করা হয়।
বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে যৌন হয়রানিও একটি নিত্যকার সমস্যা। শ্রমিকরা প্রায়ই অবাঞ্ছিত যৌন হয়রানি,এমনকি ধর্ষণেরও শিকার হয়। এই হয়রানি তাদের তত্ত্বাবধায়ক, সহকর্মী বা এমনকি গ্রাহকরাই করে থাকে। ২০১৯ সালে অ্যাকশনএইডের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ গার্মেন্টস কর্মী কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন বা প্রত্যক্ষ করেছেন। সমীক্ষায় আরও দেখা গেছে যে শ্রমিকরা যদি অল্পবয়সী হয়, যদি তারা অবিবাহিত হয়, বা যদি তারা পশ্চিমা ব্র্যান্ডগুলিতে সরবরাহ করা কারখানাগুলিতে কাজ করে তবে তাদের হয়রানির সম্ভাবনা বেশি ছিল।
বাংলাদেশের গার্মেন্টস শ্রমিকরা অনিরাপদ কাজের অবস্থারও সম্মুখীন হয়। কারখানাগুলি প্রায়শই উপচে পড়া কাঠামোতে তৈরি করা হয়। বায়ুচলাচলের ব্যবস্থা খুবই খারাপ থাকে। শ্রমিকরা প্রায়শই বিপজ্জনক রাসায়নিক এবং যন্ত্রপাতির সংস্পর্শে আসে। এই অবস্থার কারণে শ্বাসকষ্ট, ত্বকের সমস্যা এবং ক্যান্সার সহ বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা হতে পারে। ২০১৩ সালে রানা প্লানার ধ্বসের কারণ ১,১০০ জন শ্রমিক মৃত্যুবরণ করেন। বাংলাদেশে গার্মেন্টস শ্রমিকরা যে জীবনহানির বিপদের সম্মুখীন হয় এটি তার একটি প্রখর অনুস্মারক।
বিনিয়োগকারীরা এবং কারখানার মালিকরা পুষ্ট মুনাফা অর্জন করছে। আর যে হাতগুলি কঠোর পরিশ্রম করে তাদের জন্য দেওয়া হচ্ছে নামকে ওয়াস্তে মজুরি। উন্নয়নের এই ধরনের মডেল টেকসই বা নৈতিক নয়। গণতান্ত্রিক ভিন্নমতের কোনো চ্যানেল না থাকায় মরিয়া শ্রমিকরা রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়। তাদের দাবিগুলি খুবই সরল - নায্য মজুরি, মৌলিক মানবিক মর্যাদা এবং ঐক্যবদ্ধ হওয়ার অধিকার।
শ্রমিকদের স্বজনরা হাহাকার করছে। তারা কারখানার মালিক, রাজনীতিবিদ এবং কর্তৃপক্ষের দায়মুক্তির অবসান দাবি করে যারা শ্রমিকদের জীবনকে অবহেলা করে। বাংলাদেশ কি এমন একটি উন্নয়নের পথ অনুসরণ করবে যা সকলের জন্য ন্যায়সঙ্গত এবং ক্ষমতায়ন বা শ্রমজীবী দরিদ্রদের শোষণ অব্যাহত রাখবে?
লেখক- নাইমুর রহমান, ২য় বর্ষ ৪র্থ সিমেস্টার, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।