দেশে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষায় পিছিয়ে আছে চরাঞ্চলের ছোট্ট শিশুরা। এ নিয়ে যেন দায়সারা কর্তৃপক্ষ।প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারে কিছু পদক্ষেপ সরকার গ্রহন করলেও তার সম্পুর্ণ বাস্তবায়ন এখনো সম্ভব হয়নি। ফলে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কাতারে পাথরে খোদাই করার মতো উঠছে চরাঞ্চলের অবহেলিত মানুষগুলোর নাম। অন্ধকারে পতিত হচ্ছে এসব জনগোষ্ঠীর শিশুদের ভবিষ্যৎ। এমনই এক অন্ধকারাচ্ছন্ন শিক্ষাহীন জনপদে বেড়ে উঠছে ছোট্ট জিহাদ। জিহাদ, লক্ষ্মীপুরের নদীঘেরা অজপাড়াগাঁয়ের ছেলে। সদা হাসিখুশি জিহাদের বয়স ১১ পেরিয়ে বারোতে পড়তে যাচ্ছে। কৈশোর ছুঁইছুঁই এ বয়সে নিজের নাম ছাড়া আর কিছুই লিখতে পারে না সে। অক্ষরজ্ঞান বলতে তার নিজের নামটুকুই যেন সেই জ্ঞানের সম্বল।
দীর্ঘ এ জীবনে কখনো প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা তো দুরে থাক, স্কুলেই যাওয়া হয়ে ওঠেনি তার। তৃতীয় শ্রেণী পাস নিজের সমবয়সী খালাতো বোন সানিয়ার কাছ থেকে শিখেছে নিজ নাম লেখা। মোঃ জিহাদ হোসেন নামটি অনায়াসে কাগজে লিখতে পারলেও বানান করে নামটি বলা সাধ্যে ওঠে না তার । বাবা-মা, ভাই-বোনের নাম মনে থাকলেও লিখতে না পারার কষ্ট যেন কুঁকড়ে খাচ্ছে জিহাদের বুকের ভেতরটা।
কারণ জিহাদরা যে পরিবেশে বেড়ে উঠছে সে পরিবেশে থেকে তাদের অভিভাবকদের ভাববার সময় নেই যে, পড়ালেখা শেখাতে হবে সন্তানদের। চরাঞ্চলের এই জিহাদদের বয়স ৫-৬ হতেই তাদেরকে করতে হয় নানান কাজ। বাইতে হয় নৌকো। আবার মেয়েদের বেলায় বয়স ১২-১৩ হতেই দেয়া হয় বিয়ে। নিরব কষ্টে যাপিত এমন ছেলে-মেয়েদের শিক্ষার দায়িত্বই বা নেবে কারা তাও এখন প্রশ্ন?
ছোট্ট এই জিহাদের বাড়ি জেলা সদরের চররমনী মোহন ইউনিয়নের ৮নম্বর ওয়ার্ড এলাকায়। এই চরে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকায় যেন অবহেলিত এসব শিশুরা। প্রয়োজন একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের। দুঃখের বিষয় হলো, জিহাদদের বাড়ির আশাপাশের তিন কিলোমিটার পরে থাকা মাতব্বর হাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকলেও তা দুরে হওয়ায় যাতায়াত কষ্টসাধ্য বিবেচনায় ভর্তি হয় না অনেক শিশু। অভিভাবকদেরও নেই আগ্রহ।
এ তো বললাম ছোট্ট জিহাদের পড়াশোনার হালহকিকত। এবার আসি দেশের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার বেহাল দশার তীক্ষ্ণ আলোচনায়। ২০১৯ সালে ইউনিসেফ আয়োজিত বাংলাদেশে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন শীর্ষক আলোচনায় ইকবাল হোসেন নামক একজন আলোচক বলেছিলেন, এখনো সবাই প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা পাচ্ছে না। দেশে ৬০ শতাংশ শিশু শিক্ষা পায়। অবশিষ্ট ৪০ শতাংশ বঞ্চিত হয় ।
৪০ শতাংশ বঞ্চিত হওয়ার এই সংখ্যা ২০২৩ সালে এসে কিছুটা হেরফের হলেও এখনো শিক্ষা বঞ্চিত দেশের শিশুদের একটি বিরাট অংশ। লক্ষ্মীপুরের জিহাদের কথাই ধরি, যেখানে বয়েস ১২ হতে চললেও সেসহ এ চরের অনেক শিশুর ভাগ্যে জোটেনি প্রাক-প্রাথমিকের শিক্ষা সেখানে কিভাবে অক্ষরজ্ঞান ব্যতীত আগামীর স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি আমরা?
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ এবং বর্তমান সরকার গৃহীত রূপকল্প-২০৪১ তথা স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মানে দেশের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারসহ শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করা ছাড়া বাস্তবরুপ লাভ করবে না আগামীর স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন। আগামীর সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ গড়তে দেশের অবহেলিত জনপদে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার বিকল্প নেই। মনে রাখতে হবে, শিক্ষিত প্রজন্মই পারে একটি সমৃদ্ধ দেশ গড়তে।
লক্ষ্মীপুরের এই চরে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করাসহ দেশের সকল অবহেলিত এলাকার শিক্ষা বিস্তারে সরকারসহ সকল পক্ষকে অতিদ্রুত দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহন করতে হবে।