ফ্রিডম বাংলা নিউজ

শুক্রবার, নভেম্বর ২২, ২০২৪ |

EN

দুইটি নাম একটি ইতিহাস, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ

কলাম ডেস্ক | আপডেট: শুক্রবার, আগস্ট ১৯, ২০২২

দুইটি নাম একটি ইতিহাস, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ
আমি হিমালয় দেখিনি। তবে শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসে এই মানুষটি হিমালয়ের সমান। এভাবে আমি হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতাই লাভ করলাম।' বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে এভাবেই মন্তব্য করেছিলেন কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো। বঙ্গবন্ধু অসীম সাহসী মানুষ ছিলেন। এই সাহসের উৎস যদি আমরা খুঁজতে যাই- তাহলে দেখা যাবে মানবপ্রেম আর দেশপ্রেমই মূলত বঙ্গবন্ধুকে সাহসী হওয়ার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। মানবতার অবমাননা হচ্ছে, মানুষের অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে কিংবা মেহনতী মানুষ নির্যাতিত হচ্ছে এ রকম ঘটনা চোখে পড়লেই শেখ মুজিব বিদ্রোহ করে বসতেন। তার সামনে কে বা কার কাছে তিনি অধিকারের কথা বলছেন তা ভাবার অবসর ছিল না তার। তিনি অবলীলায় সমস্যার কথা উত্থাপন করে সমাধানের পথ তৈরিতে উৎসাহী হতেন।

বর্তমান বৃহত্তর ফরিদপুর জেলাকে ভাগ করা মধুমতি নদীর তীরে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ১৭ই মার্চ জন্মগ্রহণ করেন শেখ পরিবারের বড় ছেলে মুজিবুর রহমান। নিষ্ঠাবান, সৎ ও কর্তব্যপরায়ণ পিতা শেখ লুৎফর রহমান নিজ জীবনের আদর্শ ও দিকনির্দেশনা দিয়েই শিশু-কিশোর মুজিবকে জীবন ও কর্মের প্রাথমিক শিক্ষা প্রদান করেন। স্নেহময়ী রত্নগর্ভা মাতা সায়েরা খাতুনের মায়া মমতা ছাড়াও হয়ত বা নিজের অজান্তেই ব্যবস্থাপনার দীক্ষা দেন বড় ছেলেকে।পিতা মাতা ছাড়াও বিদ্যালয়ের বিজ্ঞ শিক্ষকমন্ডলী এবং গৃহশিক্ষকের কাছে শেখ মুজিবুর রহমান শুধু পুঁথিগত বিদ্যা নয় বরং জীবন চলার পথে অমূল্য সাংগঠনিক ক্ষমতা ও নেতৃত্বের শিক্ষা গ্রহণ করেন। রাজনীতির দীক্ষা তিনি গ্রহণ করেন, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কাছে পাশাপাশি শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এর কাছ থেকে। শেখ মুজিব তার কৈশোরে যখন স্কুলের ছাদ মেরামত করার জন্য তৎকালীন দুই বরেণ্য রাজনীতিক শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কাছে দাবি জানান, কিশোর মুজিবের দাবি তখন তারা গুরুত্বের সঙ্গেই নিয়েছিলেন। আজকের দিনের শিশু-কিশোররা এসব কথা ভাবতেও পারবে না সেদিন কিশোর মুজিব কী কী কর্মকাণ্ড করেছিলেন। বস্ত্রহীন মানুষকে বস্ত্র দান করে, অন্নহীনকে অন্নের ব্যবস্থা করে, সহপাঠীর সমস্যাকে আন্তরিকভাবে সমাধান করে দিয়ে কিশোর মুজিব যে দৃষ্টান্ত গড়েছেন তার কৈশোরে এ রকম দৃষ্টান্ত খুব কম মানুষের পক্ষেই স্থাপন করা সম্ভব হয়েছে বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে।কৈশোরেই বঙ্গবন্ধু যোগ দিয়েছিলেন ছাত্র-রাজনীতিতে। কলকাতায় যখন যান ইসলামিয়া কলেজে পড়তে, তখনো জড়িয়ে পড়েন ছাত্র-রাজনীতি ও মুসলিম লীগের রাজনীতির সঙ্গে। বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকে আরো জোড়ালোভাবে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ছাত্রলীগ কর্মীদের নিয়ে সভা ডাকলেন ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি, ফজলুল হক মুসলিম অ্যাসেম্বলি হলে। সেখানেই সিদ্ধান্ত হলো ছাত্র সংগঠন গঠন করার ব্যাপারে। বঙ্গবন্ধু যার নামকরণ করেন 'পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ'।

 ছাত্রলীগ গঠন করার পর সারা দেশে ছাত্রদের মধ্যে বিরাট সাড়া পড়ে, এমনকি এক মাসের মধ্যে জেলা কমিটিও গঠিত হয়েছিল। নাঈমউদ্দিন আহমেদকে যদিও বা আহবায়ক করা হয়েছিল, প্রায় সব কাজই করতেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া এ ছাত্র সংগঠনের পক্ষ থেকে পাকিস্তানি শোষকদের অত্যাচার, অন্যায় কাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও সমালোচনার পাশাপাশি আন্দোলন গড়ে ওঠেছিল।শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র ছিলেন। ১৯৪৯ সালে  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের মধ্যে দাবি-দাওয়া নিয়ে অসন্তোস চলছিল। কর্মচারীদের মাসিক বেতন ছিল নগণ্য। তাঁদের থাকার জন্য কোনো বাসস্থান ছিল না। শেখ মুজিবুর রহমান তখন তাদের আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন, যার ভয়াবহ ফলাফলও ভোগ করতে হয়েছিল তাকে। কর্তৃপক্ষ তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেন। শত বাঁধা বিপত্তি এলেও তিনি এক মুহূর্তের জন্যও থেমে থাকেন নি,বরং আরো শক্তি এবং সাহসের সাথে তা মোকাবিলা করেছেন। বাঙালি ও বাংলার প্রতিটি মুক্তি সংগ্রামে তিনি ছিলেন অকুতোভয় বীর। প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে তার ছিল অবাধ বিচরণ এবং নেতৃত্ব।শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৫৮-এর সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ৬২-এর শিক্ষা কমিশনবিরোধী আন্দোলন, ৬৬-এর ৬-দফা, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ৭০-এর নির্বাচনসহ বাঙালির মুক্তি ও অধিকার আদায়ে পরিচালিত প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও স্বাধীকার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। এ জন্য তাঁকে বহুবার কারাবরণ করতে হয়েছে। তবুও বাঙালির অধিকারের প্রশ্নে তিনি কখনো শাসকগোষ্ঠীর সাথে আপস করেননি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ন্যায়ের পক্ষে এক প্রতিবাদী নাম। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ ছিল আমাদের প্রেরণার চিরন্তন উৎস। বাঙালির বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে জাতির জনকের ওই ভাষণের দিকনির্দেশনাই ছিল জাতীয় ঐক্যের মূলমন্ত্র। অসীম ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অমিত শক্তির উৎস ছিল এই ঐতিহাসিক ভাষণ।যদিও বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ১৮ মিনিটের ভাষণটি তার স্বভাবসুলভ তাৎক্ষণিক বক্তব্য ছিল, কোন পূর্বে তৈরি করা বক্তৃতা নয়। এটিকে অনেকেই রাজনীতির কবিতা বলে থাকেন। তুলনা করা হয় আব্রাহাম লিংকন, উইনস্টন চার্চিল, মার্টিন লুথার কিং ও পেরিক্লিসের মহতী যুগান্তকারী ভাষণগুলোর সঙ্গে।

 এর মহত্ব ও বিরাটত্বের কারণে ২০১৮ সনে ইউনেস্কো বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের অসাধারণ ভাষণটিকে পৃথিবীর অন্যতম 'ওয়ার্ল্ড ডকুমেন্টারি হেরিটেজ' হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে স্বাধীনতাকামী বাঙালী জাতিকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। ভাষণটির অসাধারণত্ব, এর স্বতঃস্ফুর্ততা, নির্ভীকতা, সম্যক উপলব্ধি ও তেজস্বী উচ্চারণ এবং প্রতিবাদী কন্ঠঃস্বর প্রকৃতপক্ষে বাঙালী জনগণের প্রথমবারের মতো স্বাধীনতার চরম ও পরম আকাঙ্খাকে তীব্র করে তোলে। সামগ্রিক বিচারে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণটি স্বাধীনতাকে সংজ্ঞায়িত করেছে, চূড়ান্তভাবে স্বাধীনতা অর্জনের দিক নির্দেশনা দিয়েছে, প্রকাশ করেছে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানের রূপরেখা, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক স্বাধীনতা এবং কল্যাণ রাষ্ট্রে বিশেষ করে কম ভাগ্যবানদের অর্থনৈতিক মুক্তিসহ সোনার বাংলা গড়ে তোলা। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর বলিষ্ঠ প্রত্যয় আছে এ ভাষণের বাক্যগুলির মধ্যে। স্বাধীনতার মহামন্ত্রে উজ্জীবিত লক্ষ কোটি বাঙালীকে বাঁশের লাঠি আর দা কুড়াল নিয়ে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে সুসজ্জিত পাকিস্তানী দখলদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী প্রত্যয় নিয়ে রাস্তায় নেমে আসার নজির পৃথিবীর ইতিহাসে নাই। বঙ্গবন্ধুকে একটি ইন্টারভিউতে প্রশ্ন করা হয়েছিল আপনার শক্তি কি? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, 'আই লাভ মাই পিপল'।তাকে আবার জিজ্ঞেস করা হয় আপনার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা কী? সে প্রশ্নের জবাবে হৃদয়বান বঙ্গবন্ধু বললেন, 'আই লাভ দেম টু মাচ'।

 স্বাধীন বাংলাদেশের রুপকার, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন এদেশের স্বাধীনতার পর নিপীড়িত, নির্যাতিত মানুষের ভাগ্যেন্নয়নের কাজ শুরু করেছেন,একটু একটু করে বাংলাদেশকে আলোর পথে নিয়ে যাচ্ছিলেন ঠিক তখনই বাংলাদেশের উদীয়মান সূর্য প্রায় অস্তাচলে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ভোরে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিজ বাসভবনে স্বপরিবারে হত্যা করা হয়।(অসমাপ্ত আত্মজীবনী)। রচিত হয় ইতিহাসের সবচেয়ে কলংকিত অধ্যায়। বাংলাদেশ এবং বিশ্ববাসী হারিয়ে ফেলে এক মহান নেতাকে। সেই ছোট্ট খোকা থেকে টুঙ্গিপাড়ার শেখ মুজিবুর রহমান, অনেকের মুজিব ভাই, মাওলানা ভাসানীর মজিবর, কারোবা শেখ সাহেব, সর্বহারা, নিপীড়িত, নির্যাতিত জনগণের বঙ্গবন্ধু কিংবা স্বাধীন বাংলা ও বাঙালির জাতির পিতা।বেঁচে থাকলে হয়ত আরও অনেকদূর যেতে পারতেন এই মানুষটি। শেখ মুজিব ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া নেতা ছিলেন না। তিনি ধীরে ধীরে উপরে উঠেছেন। কারো তৈরি করা সিঁড়ি দিয়ে নয়, নিজে সিঁড়ি তৈরি করেছেন, তারপর ধাপে ধাপে উপরে উঠেছেন। মানুষের মধ্যে থেকে, মানুষকে সঙ্গে নিয়ে তিনি রাজনীতির ইমারত গড়ে তুলেছিলেন বলে তিনি মানুষকে ভালোবাসতেন, মানুষকে বিশ্বাস করতেন। আর তাই তার সবলতা যেমন মানুষকে ভালোবাসা তেমনি দুর্বলতাও মানুষকে ভালোবাসা – যা তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন।তিনি বাঙালির ইতিহাসে প্রথম স্বাধীন জাতিরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা। শেখ মুজিব একদিকে যেমন ইতিহাসের নায়ক, বরপুত্র আবার অন্যদিকে তিনি ইতিহাসস্রষ্টা।পুথিগতবিদ্যায়, বুদ্ধিমত্তায়, সৃজনশীলতায় তারচেয়ে সেরা বাঙালি হয়ত আরও এক বা একাধিক পাওয়া যাবে কিন্তু শেখ মুজিবের মতো অসীম সাহসী, দূরদর্শী এবং তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে পারদর্শী রাজনৈতিক নেতা বাঙালিদের মধ্যে আর খুব বেশি নেই। তিনি জীবনের পাঠশালা থেকে শিক্ষা নিয়ে ক্রমাগত নিজেকে অতিক্রম করেছেন, অতিক্রম করেছেন তাদের, যাদের কাছ থেকে তিনি রাজনীতির অ আ ক খ শিখেছিলেন। তিনি মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত রাজনীতিতেই ছিলেন। উপমহাদেশের এমন মানুষের সংখ্যা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, যিনি স্কুলে যাওয়ার বয়স থেকে মৃত্যু পর্যন্ত রাজনীতিতে অবগাহন করেছেন।বাঙালি জাতির গর্বের প্রতিক এই মহান মানুষটি ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন, ইতিহাস হয়েছেন।

মামুন হোসেন আগুন
কলামিস্ট ও সংস্কৃতিকর্মী।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা কলেজ,ঢাকা