বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে বিখ্যাত আইরিশ নাট্যকার ও দার্শনিক জর্জ বার্নার্ড শ বলেছিলেন, ‘‘একজন মূর্খ লোকের মস্তিষ্ক দর্শনকে মূর্খতায়, বিজ্ঞানকে কুসংস্কারে এবং শিল্পকে জীবীকায় পরিণত করে। তাই বিশ্ববিদ্যালয় মুর্খকে শিক্ষা প্রদান করে থাকে।”
আজ থেকে ঠিক ১০১ বছর পূর্বে ১৯২১ সালে তৎকালিন ব্রিটিশ ভারতে ব্রিটেনের অক্সফোর্ড ও ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বিত অক্সব্রিজ শিক্ষা ব্যবস্থা অনুসরণের লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিলো। আনুষ্ঠানিকভাবে যার শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছিলো ১৯২১ সালের ১ জুলাই। বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠালগ্নে বিখ্যাত বিজ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী ও দার্শনিকদের দ্বারা কঠোরভাবে মান নিয়ন্ত্রিত হবার প্রেক্ষিতে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
পৃথিবীর কোন বিশ্ববিদ্যালয় অদ্যাবধি যে কৃতিত্ব অর্জন করতে পারেনি, একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ ও জাতিসত্তা নির্মাণের মধ্য দিয়ে সেই চিরন্তন কৃতিত্ব অর্জন করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
আর এই একটি জায়গায় এসেই বিশ্বের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ধরনের অর্জন চিরন্তন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে ম্লান হয়ে যায়। তবে ২০২২ সালের আজকের এইদিনে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়কে মূল্যায়ন করতে গেলে দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে ইতিহাসের চড়াই উৎরাই পেরিয়ে এর সামগ্রিক অর্জনের পাশাপাশি অনুপযোগী লেখাপড়ার পরিবেশ, আবাসন সংকট, গবেষণা জালিয়াতি, প্রত্যহ বহিরাগত লোকজনের অহেতুক সমাগমের ফলে সৃষ্ট ক্যাম্পাস দূষণ, সাম্প্রদায়িকতার পশ্চাদপদ চিন্তার প্রসার, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ সহ বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক সংকট সম্পর্কে আলোকপাত জরুরি।
বাংলা ও বাঙালির ভাষার অধিকার আদায় থেকে শুরু করে স্বাধীকার ও সার্বভৌমত্ব অর্জনে সার্বিক পথনির্দেশনা দিয়েছে যে মহান প্রতিষ্ঠান তার নাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বিশেষ করে, ১৭৫৭ সাল থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত প্রায় দুইশত বছরের ইংরেজ উপনিবেশিক শাসনের সাম্প্রদায়িক প্রতিহিংসায় জর্জরিত মুসলিম জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত এই বদ্বীপ ছিলো সামগ্রিকভাবে বঞ্চিত এবং অবহেলিত।
যার ফলশ্রুতিতে এ অঞ্চলের কৃষক-কিষানী, জেলে-জেলেনীর রক্তজল করা শ্রম আর ঘামে উৎপাদিত শস্য চলে যেতো কলকাতা, দিল্লি,করাচি ও লাহোর হয়ে সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারে সুদূর লণ্ডনে! কার্যত বাঙালির উৎপাদিত ফসল কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হতো পাশ্চাত্যের তাবড় তাবড় শিল্প প্রতিষ্ঠানে। বাঙালিকে শাসন ও শোষণের মধ্য দিয়েই মূলত পাশ্চাত্যের কথিত শিল্প বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিলো। ইংরেজকর্তৃক এ অঞ্চলের কৃষকদের দিয়ে জোরপূর্বক নীল চাষের করুণ বেদনার্ত ইতিহাস তারই দগদগে ক্ষত বহন করছে। প্রসারিত বুদ্ধিমত্তা নিয়ে চিন্তার প্রকৃত সম্প্রসারণ ঘটাতে পারলেই আমরা বুঝতে পারবো যে, বাঙালিকে বঞ্চিত করে বাঙালির থেকে লুন্ঠিত সম্পদ দিয়েই দিল্লীর শাহী মসনদ, কলকাতা করাচী আর লন্ডনের রাজকীয় সব ইমারত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো।
তাই পাশ্চাত্যের আধুনিকতা ও প্রাচ্যের শাহী বালাখানা সব কিছুর পেছনে চাপা আছে কদর্য উপনিবেশিক সন্ত্রাস আর বর্গি লুটেরাদের নিকৃষ্টতম অধ্যায়। বঙ্গভঙ্গ পরবর্তি বাস্তবতায় মুসলিম জনগোষ্ঠী ও কৌম সমাজের অন্ত্যজ মানুষের আবাসভূমি পূর্ব বাংলার গণমানুষকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে জাগিয়ে তুলতে নয়া বৈশ্বিক ও আত্মবোধের বীজ বপন করেছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
পরবর্তিকালের ইতিহাসে সেই বীজ থেকেই জন্ম নিয়েছিলো ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মহান ভাষা শহীদ রফিক শফিক সালাম বরকত,জব্বার সহ নাম না জানা আরোও অনেকে, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লক্ষ শহীদ,২ লক্ষাধিক শহীদ বীরাঙ্গনা,বাংলা মায়ের শ্রেষ্ঠতম সূর্যসন্তান ইতিহাসের তূর্যবাদক বীর মুক্তিযোদ্ধারা এবং সর্বোপরি ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর তারিখ পর্যন্ত বাঙালির সার্বভৌমত্ব ও আত্মপরিচয় অর্জনে দীর্ঘ প্রায় ২৪ বছরের স্বাধীনতা সংগ্রামের মহান সেনাপতি বাংলা মায়ের ভূমিপুত্র ইতিহাসের মহানায়ক স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
অবশেষে, ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে হাজার হাজার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও মহান শিক্ষকদের আত্মত্যাগে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জিত হয়। বাঙালির আত্মপরিচয় অর্জনের পর সেই পুরাতন ব্রিটিশ আমলাতন্ত্রের যাতাকলে রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালিত হওয়ার কারনে বাঙালির আত্মসমৃদ্ধি ঘটাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কার্যত কোন অবদান রাখতে পারছেনা বা প্রতিষ্ঠানকে সঠিকভাবে পরিচালনা করা হচ্ছেনা।
সাম্প্রতিককালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সুদক্ষ সুশিক্ষিত নীতি আদর্শে বলিয়ান মানবসম্পদ সৃষ্টির চেয়ে দুর্নীতিপ্রবণ আমলা সৃষ্টিতে অধিক সক্রিয় বলেই প্রতিয়মান হয়। বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু কিছু শিক্ষক ও অধিকাংশ শিক্ষার্থীর(হিন্দু মুসলমান ও অন্যান্য সকল ধর্মাবলম্বী নির্বিশেষে) মাঝে অযৌক্তিক অন্ধ সাম্প্রদায়িকতা, কমিউনাল মানসিকতা, মোরাল পুলিশিং এর মত ব্যক্তিস্বাধীনতা হরণকারি কর্মকান্ড, এরাবিয়ান ও ইউরোপিয়ান সংস্কৃতির দাসত্ব প্রসূত উন্যাসিকতা পরিলক্ষিত হয়, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে জাতির কাম্য নয়।
এছাড়াও, শিক্ষাবাণিজ্য, অপরিষ্কার শ্রেনিকক্ষ,অস্বাস্থ্যকর ক্যান্টিন, ওয়াশরুম, অপরিচ্ছন্ন ক্যাম্পাস প্রাঙ্গণ পরিদর্শন করলে ভিনদেশি কেউ প্রথম পর্যায়ে মেলাতে কষ্ট পাবেন এই ভেবে যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি স্বাধীন দেশ ও একটি স্বাধীন জাতিসত্তা সৃষ্টি করেছে! অন্যদিকে প্রত্যহ বহিরাগত লোক সমাগমের ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়ার পরিবেশ মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছে সে দিকে যেনো কারোরই নজর নেই!
এছাড়াও, সাম্প্রতিক সময়ের সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস, মুন্সিগঞ্জ, নড়াইলে শিক্ষক নিপীড়ন ও সাভারে মাদকাসক্ত ছাত্র কর্তৃক শিক্ষক হত্যার ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির অলস, ভাবলেশহীন প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যা আরোও সুস্পষ্ট হয়েছে।
স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জনের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্জন নিয়ে আক্ষেপ করে বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রাক্তন ছাত্র খ্যাতিমান সাহিত্যিক ও চিন্তাবিদ আহমদ ছফা তাঁর স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ ‘‘যদ্যপি আমার গুরু’’ বইতে লিখেন যে,
‘‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি প্রধান অবদানের একটি হলো পাকিস্তান আন্দোলনের মনস্তাত্ত্বিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক ভিতটি তৈরি করা। দ্বিতীয় অবদান বাংলা ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বদান এবং তৃতীয় অবদান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, সংকল্প ও কর্মপন্থার দিক নির্দেশনা। এই জনগোষ্ঠীর জীবনে ওই তিনটিই অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। কিন্তু জ্ঞানচর্চার যে আরও একটা বৈশ্বিক মানদণ্ড রয়েছে তাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান বিশেষ কিছু নেই। বিশেষত পাকিস্তান সৃষ্টির পরে জ্ঞানচর্চার উত্তাপ আরও অবসিত হয়েছিলো। পাকিস্তান সৃষ্টির পরে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতো নিবেদিতপ্রাণ মানুষও নতুন কোনো গবেষণাকর্মে আত্মনিয়োগ করেননি।.....। জ্ঞানবিজ্ঞান ব্যক্তির সাধনায় বিকশিত হয়, কিন্তু সমাজের মধ্যে জ্ঞানের প্রয়োজন অনুভূত হওয়া চাই। বৃহত্তর অর্থে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাধনাও বৃহত্তর সমাজপ্রক্রিয়ার একটি অংশ। অনেক সময় উৎকৃষ্ট বীজও পাথরে পড়ে নষ্ট হয়।.....।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা বিষয়ে যে গবেষণা হয়েছে তার বেশিরভাগই চাকুরির প্রমোশনের উদ্দ্যেশ্যে লেখা।’’
পৃথিবীর এমন কোন প্রতিষ্ঠান নেই যা প্রাকৃতিকভাবেই শতভাগ সফলভাবে পরিচালিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-ও তার ব্যতিক্রম নয়। কাজেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক অর্জনের পাশাপাশি সাম্প্রতিক অর্জন না থাকার দায় প্রতিষ্ঠানটির নয়, বরং; এ প্রতিষ্ঠান যাদের হাতে পরিচালিত হয় তাদেরকেই দায়বদ্ধ হয়ে শিক্ষার্থীদের অন্তর্ভুক্ত করে সকল অসঙ্গতি দূর করতে আন্তরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা সময়ের দাবি। সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বলার মত কোন অর্জন না থাকলেও আমরা নব যুগের নব তারুণ্য আশাবাদি। মহান মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক ভাবগাম্ভীর্য ও মান মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রেখে বিশ্ব দরবারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে সম্মানের আসনে আসীন করতে নতুন প্রজন্ম বদ্ধ পরিকর।
আজ ১ জুলাই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম দিবসের এই মাহেন্দ্রক্ষণে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মহান বাণী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি প্রাণের দৃপ্ত শপথ হয়ে উচ্চারিত হোক ,
‘‘ঊষার দুয়ারে হানি’ আঘাত
আমরা আনিব রাঙা প্রভাত
আমরা টুটাব তিমির রাত
বাধার বিন্ধ্যাচল।
নব নবীনের গাহিয়া গান
সজীব করিব মহাশ্মাশান
আমরা দানিব নূতন প্রাণ
বাহুতে নবীন বল।’’