ফ্রিডম বাংলা নিউজ

রবিবার, জুন ১৬, ২০২৪ |

EN

চার নেতার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তায়

নির্বাচনপরবর্তী সহিংসতা ঠেকাতে ব্যর্থ, কেউ কেউ ভোটের পর থেকে নিরুদ্দেশ


বিশেষ প্রতিবেদক | আপডেট: মঙ্গলবার, জানুয়ারী ১৬, ২০২৪

চার নেতার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তায়
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হেরে চরম অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে দক্ষিণের চার আওয়ামী লীগ নেতার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ। দলীয় প্রতীক নৌকার বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করে তাদের এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে অনুসারীদের ওপর নির্বাচনপরবর্তী সহিংসতা ঠেকাতে চার নেতা ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। কেউ কেউ আবার ভোটের পর থেকে নিরুদ্দেশ। বিপদে থাকা নেতাকর্মীদের খোঁজখবরও নিচ্ছেন না তারা। সবকিছু মিলিয়ে রাজনীতিতে তারা আবার ফিরতে পারবেন কিনা সেটাই প্রশ্ন নির্বাচনি এলাকার সাধারণ মানুষের।

ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু : ৩০-৩২ বছর ধরে বরগুনায় আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে আসছিলেন বর্ষীয়ান নেতা ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু। টানা ২৭ বছর ধরে তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে আছেন। এর আগে ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। বরগুনা-১ আসনে শম্ভু এবার নিয়ে সাতবার দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন। এমপি হয়েছেন পাঁচবার। বিদ্রোহী প্রার্থী সাবেক জেলা চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেনের কাছে প্রথমবার তিনি পরাজিত হন। সর্বশেষ ৭ জানুয়ারির ভোটে তাকে হারিয়ে এমপি হয়েছেন ঈগল প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী দলের জেলা যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গোলাম সরোয়ার টুকু। গণনায় কারচুপি ও ভুলের কারণে হেরেছেন দাবি করে শম্ভু বিবৃতি দিয়েছেন। যদিও এ দাবি মানতে নারাজ সেখানকার আওয়ামী লীগের নেতারা।

দলের কেন্দ্রীয় নেতা মশিউর রহমান শিহাবের মতে, শম্ভুর অনিয়ম-দুর্নীতি বেড়ে গিয়েছিল। একনায়কতন্ত্রটাও জেঁকে বসেছিল কঠিনভাবে। এ কারণে তিনি হেরেছেন। নির্বাচনের পর স্থানীয় পর্যায়ে প্রভাবও যেন খোয়াতে বসেছেন তিনি। এরইমধ্যে পক্ষ বদলের ছোটাছুটি শুরু হয়েছে। শম্ভুকে ছেড়ে অনেকে টুকুর দিকে ঝুঁকছেন। জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুল মোতালেব মৃধা বলেন, এ হার থেকে তার শিক্ষা নেওয়া উচিত। টানা ৩০ বছর আওয়ামী লীগকে পকেটবন্দি করে রেখেছেন তিনি। ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাকর্মীদের সঠিক মূল্যায়ন করেননি। পারিবারিক বলয়ে দলকে জিম্মি করা হয়েছে।

মাহবুবুর রহমান তালুকদার : দলের দুঃসময়ের কান্ডারি হয়েও নিজের ভুলে সব হারিয়েছেন মাহবুব রহমান তালুকদার। নির্বাচনে তার হেরে যাওয়ার ব্যাখ্যা এভাবেই দেন পটুয়াখালী-৪ আসনের দলীয় নেতাকর্মীরা। নৌকার মনোনয়নে সাবেক পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহবুব তিনবার এমপি হয়েছেন। কলাপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি তিনি। ঈগল প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্র্থী হয়ে নেমেছিলেন ভোটে। হেরে যান নৌকার মহিববুর রহমানের কাছে। দ্বিতীয় দফায় এমপি হওয়া মুহিবকে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী করেছে সরকার। নিরুদ্দেশ মাহবুব। ভোটের পর হামলার শিকার হওয়ার অভিযোগ উঠে মাহবুব অনুসারীদের। তবে তাদের কারও কোনো খোঁজ নেননি তিনি।

উপজেলা চেয়ারম্যান ও কলাপাড়া আওয়ামী লীগ সহসভাপতি রাকিবুল আহসান বলেন, নির্বাচনের পর থেকে শুনছি তিনি অসুস্থ। শুক্রবার ঢাকায় গেছেন। তার উচিত ছিল বিপদগ্রস্ত নেতাকর্মীদের পাশে দাঁড়ানোর। কলাপাড়ার পৌর মেয়র ও পৌর আওয়ামী লীগ সভাপতি বিপুল চন্দ্র হাওলাদার বলেন, জনরায় তো তিনি পেয়ে গেছেন। এখন কি করবেন সেটা তার ভাবনা। যতদূর জানি তার বয়স ৭২ বছর। সামনের দিনগুলো তার জন্য সহজ হবে না।

একেএমএ আউয়াল : দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে হারিয়ে এমপি হয়ে আলোড়ন ফেলেছিলেন পিরোজপুর-১ আসনের সাবেক এমপি একেএমএ আউয়াল। সেটা ছিল তার প্রথম নির্বাচন। ২০১২ সালের নির্বাচনেও তিনি এমপি হন। দ্বিতীয় দফায় সংসদ-সদস্য থাকাকালে নানা বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন আউয়াল। তার বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠে। এবার তিনি ঈগল প্রতীক নিয়ে লড়েন। নৌকার প্রার্থী সদ্য সাবেক মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমের কাছে তিনি হেরেছেন। পরাজিত হলেও স্থানীয় রাজনীতিতে আউয়াল পিছিয়ে পড়বেন কিনা তা নিয়ে অবশ্য বিতর্ক রয়েছে। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি তিনি। তিন ভাইয়ের দুজন পিরোজপুর সদর উপজেলা চেয়ারম্যান এবং পৌর মেয়র। এক ভাইয়ের স্ত্রী জেলা চেয়ারম্যান। খুব সহজেই যে তিনি পিছ-পা হবেন না তা নিশ্চিত। তবে ভোটে হারের কারণে হয়তো খানিকটা জটিলতায় পড়বেন।

জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও পিরোজপুরের পৌর মেয়র হাবিবুর রহমান মালেক বলেন, ভোটের ব্যবধান ইঙ্গিত দেয় কতটা জনপ্রিয় আউয়াল। বাকিটা ভবিষ্যতে দেখা যাবে।

ডা. রুস্তুম আলী ফরাজী : পিরোজপুর-৩ আসনে হেরে গিয়ে ভবিষ্যতের সবটাই যেন খুঁইয়েছেন চারবারের সাবেক এমপি ডা. রুস্তুম আলী ফরাজী। পরাজয়ের জন্য তাকেই দুষছেন এলাকার সবাই। তাদের অভিযোগ-এমপি হওয়ার জন্যই যেন তিনি রাজনীতি করেন। মঠবাড়িয়ার পৌর প্রশাসক ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেলিম মাতব্বর বলেন, কখনোই কোনো দলের রাজনীতি ধারণ করতে পারেননি ফরাজী। কখনো বিএনপি করেছেন, কখনো জাতীয় পার্টি করেছেন। আওয়ামী লীগেও ঢোকার চেষ্টা ছিল। কোনো একটা দল নিয়ে পড়ে থাকলে হয়তো তার এ অবস্থা হতো না। বিএনপি ছেড়ে জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে এমপি হয়েছিলেন ফরাজী। এমপি হওয়ার পর বেমালুম ভুলে যান জাতীয় পার্টিকে। এর আগে বিএনপির এমপি হয়েও তিনি একই ঘটনা ঘটান। এবার তাকে জাতীয় পার্টি মনোনয়ন দেয়নি। স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে লড়তে গিয়ে তিনি হেরেছেন।

উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি রাফিউদ্দিন আহম্মেদ ফেরদৌস বলেন, রাজনৈতিক আদর্শ বলতে ফরাজীর আছে শুধু এমপি হওয়া। যখন যেদিকে সুবিধা পেয়েছেন ছুটেছেন। এ কারণে এবার তাকে প্রায় অখ্যাত একজনের কাছে হারতে হয়েছে। এরপর তিনি আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন বলে মনে হয় না।

আলোচ্য চার নেতার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে একেএমএ আউয়াল ছাড়া কাউকে পাওয়া যায়নি। ফোন ধরেননি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু ও মাহবুবুর রহমান তালুকদার। রুস্তুম আলী ফরাজীর মোবাইল ফোন ছিল বন্ধ। একেএমএ আউয়াল বলেন, ‘হার-জিত আছে বলেই তো নির্বাচন। একবার হেরেছি বলে রাজনীতি তো শেষ হয়ে যায়নি। মানুষের জন্য রাজনীতি করি, সেটা যেমন অব্যাহত থাকবে তেমনি সময়ই বলে দেবে যে রাজনীতির গতিপ্রকৃতি কাকে কোথায় নিয়ে যাবে।’