অবিশ্বাস্য সব গল্পের জন্ম দিয়ে উঠে আসা মরক্কোর বুকে শুরুতেই আঘাত হানে ফ্রান্স। তাতে অবশ্য ঘাবড়ে যায়নি আফ্রিকার দলটি। একের পর এক শাণাতে থাকে পাল্টা আক্রমণ। ছড়াতে থাকে ভীতি। তবে, নিশ্চিত কয়েকটি সুযোগ হারানোয় নতুন কোনো বিস্ময় উপহার দেওয়া আর হলো না তাদের। আরেকটি দারুণ পারফরম্যান্সে নতুন ইতিহাস গড়ার স্বপ্ন নিয়ে ফাইনালে পা রাখল দিদিয়ে দেশমের দল।
আল বাইত স্টেডিয়ামে বুধবার রাতে দ্বিতীয় সেমি-ফাইনালে দুই অর্ধের দুই গোলে ২-০ ব্যবধানে জিতেছে শিরোপাধারীরা। থিও এরনঁদেজের দারুণ গোলে তারা এগিয়ে যাওয়ার পর ব্যবধান বাড়ান রন্দাল কোলো মুয়ানি।
২০০২ সালে ব্রাজিলের পর প্রথম দল হিসেবে টানা দ্বিতীয়বার বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠল ফ্রান্স। সেখানে তাদের প্রতিপক্ষ বিশ্ব মঞ্চে ৩৬ বছরের শিরোপা খরা কাটানার স্বপ্নে বিভোর আর্জেন্টিনা।
পঞ্চম মিনিটেই এগিয়ে যায় ফ্রান্স। রাফায়েল ভারানের দারুণ থ্রু বল পেয়ে বক্সে ঢুকে পড়েন অঁতোয়ান গ্রিজমান। তার পাস ধরে ঠিকমতো শট নিতে পারেননি কিলিয়ান এমবাপে, তবে তার দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় প্রতিপক্ষের পায়ে লেগে বল চলে যায় বাঁ দিকে থিও এরনঁদেজের কাছে। কাঁধ সমান উঁচু বলে দারুণ অ্যাক্রোবেটিক শটে পোস্ট ঘেঁষে গোলটি করেন এসি মিলান ডিফেন্ডার।
আসরে প্রথম পাঁচ ম্যাচে স্রেফ একটি গোল হজম করা দলের এমন শুরুতে মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায় মরক্কো গ্যালারি। পাঁচ মিনিট পর সমতা টানতে পারত তারা। কিন্তু আজ্জেদিন উনাহির দূরপাল্লার জোরাল শট ঝাঁপিয়ে ঠেকিয়ে দেন গোলরক্ষক উগো লরিস।
সপ্তদশ মিনিটে আবারও প্রতিপক্ষ শিবিরে হানা দেয় ফরাসিরা। এবার প্রতি-আক্রমণে ইব্রাহিমা কোনাতের পাস ধরে জোরাল শট নেন অলিভিয়ে জিরুদ, বল গোলরক্ষককে এড়ালেও পোস্ট এড়াতে পারেনি।
এরপরই আরেক বড় ধাক্কা খায় প্রথম আফ্রিকান দল হিসেবে সেমি-ফাইনালে আসা মরক্কো। চোট পেয়ে মাঠ ছাড়েন অভিজ্ঞ ডিফেন্ডার রোমাঁ সাইস। বদলি নামেন সেলিম আমাল্লাহ।
৩৬তম মিনিটে মুহূর্ত ব্যবধানে দারুণ দুটি সুযোগ পেয়েও কাজে লাগাতে পারেনি ফ্রান্স। অহেলিয়া চুয়ামেনির পাস বক্সে পেয়ে এমবাপের নেওয়া শট রুখে দেন আশরাফ হাকিমি, তবে বল ফের চলে যায় চুয়ামেনির পায়ে। তিনি এবার খুঁজে নেন বক্সে অরক্ষিত অলিভিয়ে জিরুদকে। তার শট হয় লক্ষ্যভ্রষ্ট।
বিরতির আগের কয়েক মিনিটে প্রবল চাপ তৈরি করে মরক্কো। ৪৫তম মিনিটে দুর্ভাগ্য বাধা না হয়ে দাঁড়ালে গোলও পেতে পারত তারা। কর্নার থেকে উড়ে আসা বল ডিফেন্ডাররা পুরোপুরি ক্লিয়ার করতে ব্যর্থ হলে বক্সেই পেয়ে যান জাওয়াদ এল ইয়ামিক। তার ওভারহেড কিক পোস্টে লাগে।
প্রথমার্ধের মতো বিরতির পরও পজেশন ধরে রেখে আক্রমণে উঠতে থাকে মরক্কো। পরিকল্পিত আক্রমণে পরপর দুই মিনিটে ফ্রান্সের বক্সে ভীতি ছড়ায় তারা। ৫৪তম মিনিটে সোফিয়ান আমরাবাত ঠিকমতো শট নিতে পারেননি, বল চলে যায় বাইরে।
তিন মিনিট পর ছয় গজ বক্সের বাইরে বল পেয়েও শট নিতে ব্যর্থ হন আশরাফ হাকিমি। ৬৫তম মিনিটে জিরুদের বদলি নামার ছয় মিনিট পর দারুণ সুযোগ পেয়েও নষ্ট করেন মার্কাস থুরাম। গ্রিজমানের ফ্রি কিকে বল আয়ত্ত্বে পেয়ে হেড লক্ষ্যে রাখতে পারেননি তিনি।
৭৫তম বল পায়ে ডি-বক্সে ঢুকে দারুণ সম্ভাবনা জাগালেন আব্দেররাজাক হামদাল্লাহ। তবে ওই পর্যন্তই, দ্বিধায় পড়ে শটই নিলেন না। হারিয়ে ফেললেন বলও।
এর পাঁচ মিনিট পরই ব্যবধান দ্বিগুণ করে ফ্রান্স।
বাঁ দিকে থুরামকে বল বাড়িয়ে বক্সে ঢুকলেন এমবাপে। ফিরতি পাস পেয়ে একজনকে কাটিয়ে প্রতিপক্ষের আরও তিন জনের মধ্যে থেকে শট নিলেন পিএসজি তারকা। একজনের পায়ে লেগে বল চলে গেল দূরের পোস্টে। ফাঁকায় পেয়ে ডান পায়ের টোকায় বল জালে পাঠিয়ে উল্লাসে ফেটে পড়লেন ৪৪ সেকেন্ড আগেই দেম্বেলের বদলি নামা কোলো মুয়ানি।
পুরো ম্যাচে ৬০ শতাংশের বেশি সময় বল দখলে রেখে সমানতালে আক্রমণ করে যাওয়া মরক্কো গোলের উদ্দেশ্যে শট নেয় ১৩টি, প্রতিপক্ষের চেয়ে একটি কম। লক্ষ্যে শট রাখার ক্ষেত্রে দুই দলই সমান ৩টি; কিন্তু সেখানে নিখুঁত হতে পারেনি মরক্কো।
যোগ করা সময়ে আরও একবার সুযোগ তৈরি করে প্রথমবার শেষ আট ও শেষ চারে ওঠা আরব দলটি। কিন্তু এবারও কাজের কাজ করতে পারেনি তারা।
শেষের বাঁশি বাজতেই শেষ হয় তাদের অবিশ্বাস্য এক যাত্রার। টিভি ক্যামেরায় ধরা পড়ে মরক্কান সমর্থকদের হতাশায় ঢাকা মুখ। হাকিমি-জিয়াশদের চোখে-মুখেও ভর করে আরও বড় স্বপ্নের হাতছোঁয়া দূরত্ব থেকে বিদায়ের কষ্ট।
র্যাঙ্কিংয়ের ২২তম দলটির জন্য এই অর্জনও অনেক বড়। দেশের মানুষের কাছে তো তারা অনেক আগেই বীরের মর্যাদা পেয়ে গেছে। তবে ক্রোয়েশিয়া ও বেলজিয়ামের গ্রুপ থেকে সেরা হয়ে নকআউট পর্বে ওঠা, স্পেন ও পর্তুগালের মতো দলকে হারিয়ে এতদূর আসার পর স্বপ্নের ডানা তো মেলারই কথা। তাই আকাশছোঁয়া প্রাপ্তির মাঝেও যেন রয়ে গেল শেষটা আরেকটু উজ্জ্বল না হওয়ার হতাশা।
আর ফ্রান্স শিবিরে ফাইনালে ওঠার উচ্ছ্বাস। ব্রাজিলের ২০ বছর পর প্রথম দল হিসেবে টানা দ্বিতীয়বার ফাইনালে ওঠা তো হলো, এবার লক্ষ্য সেলেসাওদেরই ১৯৬২ সালে গড়া টানা দুবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার রেকর্ড ছোঁয়ার।
আগামী রোববার লুসাইল স্টেডিয়ামে বসবে শিরোপার লড়াই।