ফ্রিডম বাংলা নিউজ

শুক্রবার, নভেম্বর ২২, ২০২৪ |

EN

বরিশালে মাদক নিরাময় কেন্দ্রে মৃত্যু : দেড় লাখ টাকায় রফাদফা

আল মামুন, বরিশাল প্রতিনিধি | আপডেট: রবিবার, আগস্ট ২৯, ২০২১

বরিশালে মাদক নিরাময় কেন্দ্রে মৃত্যু : দেড় লাখ টাকায় রফাদফা
মাদকাসক্তি চিকিৎসা সহায়তা ও পুনর্বাসন কেন্দ্র হলি কেয়ারে রহস্যজনক মৃত্যু হওয়া চন্দন সরকারের মৃতদেহের ময়না তদন্ত সম্পন্ন করা হয়েছে।
 

শনিবার শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ (শেবাচিম) হাসপাতালের মর্গে তার ময়না তদন্ত হয়। পরে মৃতদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।


তবে ঘটনার দুদিন অতিবাহিত হলেও এই ঘটনায় কোন মামলা কিংবা নির্যাতনের ঘটনায় হলি কেয়ার সংশ্লিষ্ট কাউকে আটক করেনি পুলিশ। বরং পুলিশের সহযোগিতায় মাত্র দেড় লাখ টাকায় চন্দনের রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনাটি রফাদফার চেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে।


নিহতের হতদরিদ্র স্বজনদের ওপর চাপ সৃষ্টির পাশাপাশি ভুল বুঝিয়ে শুক্রবার রাতে হলি কেয়ারে সমঝোতা হয় বলে নির্ভরযোগ্য সূত্র নিশ্চিত করেছে। স্বজনরা মামলা না করার শর্তে দেড় লাখ টাকার চেক নিহতের পরিবারকে দেয়া হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে। 


এদিকে, চন্দনের মৃত্যুর ঘটনায় মামলা না হওয়ায় এবার পার পেয়ে যাচ্ছে চিকিৎসার নামে সিরিয়াল কিলার হলি কেয়ার মাদকাসক্তি চিকিৎসা সহায়তা ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের মালিক মোস্তাফিজুর রহমান সুমন সহ অভিযুক্তরা।


যদিও শুক্রবার ঘটনার পর থেকেই হলি কেয়ারে চিকিৎসাধীন রোগীদের স্বজনরা ভীড় জমায়। অনেকেই তাদের সন্তানদের নিজ নিজ দায়িত্বে সেখান থেকে নিয়ে গেছেন। আবার অনেক স্বজন ঘটনা জানতে পেরে তাদের সন্তানদের নিয়ে আসলেও পরিবারের সদস্যদের ভুল বুঝিয়ে পাঠিয়ে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে হলি কেয়ার কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে।


নিহত চন্দন সরকারের পরিবারের সদস্যরা জানান, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর হলি কেয়ার কার্যালয় বসে তাদের সঙ্গে মামলা না করার শর্তে সমঝোতা করা হয়। তাদেরকে দেড় লাখ টাকা চেকের মাধ্যমে প্রদান করা হবে বলে আশ্বাস দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটির মালিকপক্ষ। 


তবে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তাদের কোন চেক দেয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন।
নিহত চন্দনের মামা নিবাস মুহুরী বলেন, আমরা অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের সদস্য। শুনেছি হলি কেয়ার এর মালিক মোস্তাফিজুর রহমান সুমনের অনেক টাকা। প্রশাসনের লোকেদের সাথে নাকি তার অনেক সখ্যতা রয়েছে। মামলা না করার জন্য আমাদের বিভিন্ন ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। ফলে আমরা এ মুহূর্তে মামলা করার সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছি। মামলা করে আমাদের সাথে টিকে থাকা পারব না। মামলা করা না হলে আমাদের দেড় লাখ টাকা দেয়া হবে বলে আশ্বস্থ করলে এখন পর্যন্ত কোন টাকা বা চেক পাইনি।


খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা সরেজমিনে হলি কেয়ার পরির্দশন করলে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোন আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। অর্থ আর ক্ষমতার বলে তাদেরকেও ম্যানেজ করা হচ্ছে বলে প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে।

অপরদিকে, হলি কেয়ার কেন্দ্র সরেজমিনে পরিদর্শন করেছেন উপ-পুলিশ কমিশনার আলী আশরাফ। 

পরিদর্শনকালে তিনি বলেছেন, সিসিটিভি ক্যামেরা পর্যবেক্ষণ করা হবে। কিন্তু বৃহস্পতিবার ঘটনার রাতে সাড়ে দশটার সময় চন্দনকে মারধর করে পা দিয়ে পৃষ্ঠ করা হয় বলে প্রত্যক্ষদর্শী অন্যান্য রোগীরা অভিযোগ করলেও এ বিষয়ে কাউকে আটক করেনি পুলিশ। এমনকি মুছে ফেলা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ উদ্ধারের বিষয়েও কোন পদক্ষেপ নেন নি তারা। ফলে নগরবাসীর মনে অমানবিক এ হত্যাকান্ড নিয়ে রহস্য তৈরি হয়েছে।


স্থানীয় বাসিন্দা রাজন জানান, প্রায়ই এখানে নির্যাতনে রোগীদের কান্নার ও চিৎকারের শব্দ পাওয়া যেত। এর আগেও একাধিক রোগীর সঙ্গে এসব নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে রোগীর অভিভাবকদের সঙ্গে সালিশ বৈঠকের ঘটনা ঘটেছে। এর আগেও অনেকে আরো ৪ জন রোগী পিটিয়ে হত্যা এবং নির্যাতন সহ্য করতে না পারা কয়েকজন রোগী পালিয়ে যাবার কথা আমরা শুনেছি। এখন রোগী আত্মহত্যা করলেও কর্তৃপক্ষ দায় এড়াতে পারে না। এমনকি কোনো ধরনের মানসিক চিকিৎসার লাইসেন্স না থাকার পরেও কিভাবে এখানে মানসিক রোগী ভর্তি করা হলো এ বিষয়টি প্রশাসনের খতিয়ে দেখা উচিত।


এদিকে টর্চার সেল হলি কেয়ারে রোগী রাখার জন্য নেই কোনো ধরনের চিকিৎসা ব্যবস্থা। শুক্রবারের ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশ পেলে ওই দিনই বেশ কয়েকজন অভিভাবক এসে হলি কেয়ার থেকে তাদের সন্তানদের নিয়ে গেছে। অভিযোগ রয়েছে, বেশ কয়েকজন অভিভাবক আসলেও তাদের সাথে সন্তানদের দেখা কিংবা তাদের নিয়ে যেতে দেয়নি হলি কেয়ার কর্তৃপক্ষ। এসবকিছু দেখেও রহস্যজনক কারণে পুলিশের নিরাবতা নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে।
এসব বিষয় নিয়ে ঘটনার দিন হলি কেয়ার এর নির্যাতনকারী ভলান্টিয়ার সরোয়ার বলেন, মাঝেমধ্যে মারধর করা হয়, তবে সেটা নিয়মিত নয়। হলি কেয়ার কেন্দ্রের ইনচার্জ মাইনুল হক ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন রোগীকে রাতে মারধর করা হয়েছে, কিন্তু হত্যা করা হয়নি। সে বাথরুমে গিয়ে আত্মহত্যা করেছে।


এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে কোতয়ালী মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ এবং পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) এর সরকারি মুঠোফোন নম্বরে একাধিকবার ফোন করা হলেও তারা রিসিভ করেন। 


তবে থানার একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, শনিবার সকালে চন্দন সরকারের মৃতদেহের ময়না তদন্ত শেষে মৃতদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

তিনি জানিয়েছেন, এই ঘটনায় নিহতের স্বজনরা নিয়মিত মামলা করতে চেয়েছিলেন। তবে হঠাৎ করেই তারা তাদের মত পাল্টে ফেলেন। এ নিয়ে কোন মামলার ঝামেলায় যাবে না বলে পুলিশকে জানিয়েছে। তাই শুধুমাত্র একটি অপমৃত্যু মামলাই হয়েছে। ময়না তদন্ত রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে পরবর্তীতে চাইলে তারা মামলা করতে পারবেন।