মর্গ বা লাশ কাটা ঘরে ডোমরাই (শব ব্যবচ্ছেদ কর্মী) রাজা। কারও ধার ধারেন না তারা-একেবারেই নিয়ন্ত্রণহীন। এদের অনেকেই বেশিরভাগ সময় নেশায় বুঁদ থাকেন। শিক্ষার আলোহীন এসব ডোমের কেউ কেউ লাশের ওপর বিকৃত যৌনাচার করেন। সম্প্রতি এমন ঘটনায় দুজন ডোমকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। ফরেনসিক বিভাগ এবং এর আওতায় থাকা মর্গ খুবই স্পর্শকাতর হলেও এ বিভাগেই লোকবল সংকট সবচেয়ে বেশি। নেই পর্যাপ্ত বিশেষজ্ঞ শিক্ষক-চিকিৎসক, নার্স, অবকাঠামো ও আধুনিক যন্ত্রপাতি। প্রতিটি সরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে নেই স্থায়ী ডোম। এছাড়া ডোমরা টাকার জন্য লাশের স্বজনদের হয়রানি করেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। এ কারণে মর্গ ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজানোর পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল মাহমুদ যুগান্তরকে বলেন, লাশের সঙ্গে বিকৃত যৌনাচারকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় ‘নেক্রোফিলিয়া’ বলা হয়। এটি বিকারগ্রস্ত মানসিক রোগ। জ্ঞানহীন, অনভিজ্ঞ, প্রশিক্ষণহীন ডোমদের মাঝে এমন বিকৃত মনোভাব আসতে পারে। ফলে প্রশিক্ষিত, অভিজ্ঞ ডোমের কোনো বিকল্প নেই।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল মর্গে এ বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি এক নারী ও এক কন্যাশিশুর লাশে যৌন আক্রমণের (ধর্ষণ) অভিযোগে ডোম সেলিমকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ ঘটনায় ২ মার্চ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মর্গটি বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়। এর আগে গত বছরের ১৯ নভেম্বর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে মুন্না ভগত নামে এক ডোমকে একই অপরাধে গ্রেফতার করা হয়। সে মর্গে থাকা মৃত নারীদের ধর্ষণ করে আসছিল বহু বছর ধরে। সিআইডির তদন্তে ওই মর্গে একাধিক লাশে শুক্রাণু পাওয়া যায়।
দেশে বর্তমানে সরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সংখ্যা ৩৭টি। এগুলোয় ফরেনসিক বিভাগে শিক্ষকের আসন রয়েছে ১৩০টি। এর বিপরীতে শিক্ষক আছেন মাত্র ৩০ জন। বেশ কয়েকটি কলেজে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ কিংবা ডিগ্রিধারী কোনো চিকিৎসকই নেই। নিয়ম অনুযায়ী যেসব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ফরেনসিক বিভাগ থাকে, সেখানে মর্গ থাকতে হবে। সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৬৬টি মর্গ রয়েছে। তাছাড়া জেলা হাসপাতাল মর্গগুলো মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের আওতাধীন। এসব মর্গে কোথাও একজন, কোথাও দুজন ডোম অস্থায়ীভাবে দায়িত্ব পালন করছেন। নির্ধারিত বেতনও সময়মতো হয় না তাদের। ফলে ডোমরা অর্থের জন্য বেপরোয়া থাকেন। কাটাছেঁড়া লাশ যথাযথ সেলাই কিংবা নিয়মতান্ত্রিকভাবে মর্গ থেকে লাশ বের করে দেয়ার ক্ষেত্রে স্বজনদের কাছে টাকা দাবি করেন তারা। এক্ষেত্রে হেরফের হলেই, এবড়ো-খেবড়োভাবে লাশ ফেলে রাখেন তারা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের (ডিজিএইচএস) এক কর্মকর্তা বলেন, মর্গে লাশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি। আমরা সিসি ক্যামেরা স্থাপনসহ সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে কি কি করা যায়, তা নিয়ে কাজ করছি। স্থায়ী ডোম নিয়োগসহ ফরেনসিক বিভাগে লোকবল, বিশেষজ্ঞ চিকিৎক, অবকাঠামো এবং আধুনিক সরঞ্জাম নিশ্চিত করতেও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেশিরভাগ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থায়ী ডোম না থাকায় লাশের ময়নাতদন্তের কাজ ব্যাহত হচ্ছে। যেসব ডোম অস্থায়ী ভিত্তিতে আছে, তাদের কোনো জবাবদিহিতা নেই। এ প্রসঙ্গে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের এক চিকিৎসক যুগান্তরকে বলেন, এখানেও ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ ও এর আওতায় থাকা মর্গে লোকবল স্বল্পতা রয়েছে। শিক্ষার্থীদের শেখার সুযোগ একেবারেই কম। তিনি বলেন, যে পরিমাণ শিক্ষার্থী, তাদের জন্য ডোম ঘরের পরিবেশ, অবকাঠামো এবং সরঞ্জাম যথাযথ নয়। লাশের কাটাছেঁড়া ইঞ্চি ইঞ্চি করে ধীরে ধীরে করতে হয়। কিন্তু ডোমরা বেপরোয়া হয়ে কাজ করে। তাদের নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। অস্থায়ী হওয়ায় তাদের নিয়মের মধ্যে আনাও কঠিন।
সরেজমিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গ ঘুরে দেখা যায়, পাশাপাশি দুটি ঘর। একটি প্রায় এক যুগ আগের। নতুন মর্গ ঘরটিতে লাশ কাটা হয়। পুরাতনটিতে লাশ রাখা হয়। কোথাও সিসি ক্যামেরা নেই। লাশগুলো ডোমের নিয়ন্ত্রণেই থাকে। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, মর্গ এলাকা একেবারেই নিরাপত্তাহীন। এক অস্থায়ী ডোম জানান, এখানে বাধ্য হয়েই কাজ করেন তারা। সমাজ পরিবারে তারা ঘৃণিত মানুষ। পরিবারেও ভালোবাসা পান না। নেশা করার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, বাধ্য হয়েই লাশের স্বজনদের কাছ থেকে টাকা-পয়সা নেই। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগ আরও নাজুক। জরাজীর্ণ মর্গের ঘরগুলোয় ভূতুড়ে পরিবেশ। মর্গে কোনো স্থায়ী ডোম নেই। এখানেও নেই সিসি ক্যমেরা। একজন কর্মচারী বলেন, ডোমরা প্রকাশ্যেই নেশা করে। লাশ ঘরেই নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে তারা। এক ডোম বলেন, ‘নেশা করতে হয়। নেশা না করে এ কাজ করা যায় না। এটা সবাই জানে।’
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল মাহমুদ যুগান্তরকে বলেন, এ বিভাগে লোকবল স্বল্পতা দীর্ঘদিনের। ডোমরা অস্থায়ী, তাদের কোনো প্রশিক্ষণ নেই। যুগের পর যুগ ধরে এদের দিয়েই স্পর্শকাতর কাজগুলো করানো হচ্ছে। এখানে নিরাপত্তা জোরদার করাসহ স্থায়ী লোকবল নিয়োগ দেয়া খুবই জরুরি। তিনি বলেন, ফরেনসিক বিভাগে নারীরা আসতে চান না, ডোমতো নয়ই। তবে ডোমেও নারী আসা সময়ের দাবি।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. আ ম সেলিম রেজা বলেন, লাশের সঙ্গে বিকৃত ঘটনার পর সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। কিন্তু, স্থায়ী ও প্রশিক্ষিত ডোম প্রয়োজন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ফরিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, মর্গে এমন ঘটনা খুবই ন্যক্কারজনক। এ কারণে প্রশিক্ষিত ও মানবিক ডোমের কোনো বিকল্প নেই। এ খাতে লোকবল নিয়োগ জরুরি স্বীকার করে তিনি বলেন, মর্গের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করছি। নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য হাসপাতাল সংশ্লিষ্টদের চিঠি দেয়া হবে।