ফ্রিডমবাংলানিউজ ডেস্ক | আপডেট: রবিবার, আগস্ট ২৯, ২০২১
জামালপুরের
বকশিগঞ্জ উপজেলার নিলক্ষিয়া ইউনিয়নের জানকিপুর দড়িপাড়া গ্রামে ফুল মামুদ (৪৫)
ও মোছা. নাছিমা বেগমের (৩৬) পাঁচ সন্তানের
চারজনই দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। চার ছেলে ও
এক মেয়ের মধ্যে শুধুমাত্র কন্যা সন্তানটিই চোখে দেখতে পায়।
ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে জন্মের কয়েক মাসের মধ্যেই
দৃষ্টি হারিয়ে ফেলা চার সন্তানকে
নিয়ে বিপাকে রয়েছে পরিবারটি। এতে নিম্ন আয়ের
পরিবারটি অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে।
দৃষ্টি প্রতিবন্ধী এই চার ভাই হলেন- নাজমুল হক (২২), নয়ন (২০), মো. মোফাজ্জ্বল হক (১৭) ও আজিম উদ্দিন (১২)। এর মধ্যে সবার বড় নাজমুল বিয়ে করেছেন। তার দুইটি সন্তানও রয়েছে। এছাড়া বাকি তিনজন পড়াশোনা করছেন। অর্থের অভাবে সুচিকিৎসা করাতে পারেননি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী এ চার ভাই। এছাড়া তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন বাবা-মা। সরকারের কাছে সন্তানের জন্য সব ধরনের সহায়তার দাবি জানিয়েছেন তারা।
পিতা
ফুল মামুদ বলেন, ‘আমার জমি আছে
তিন বিঘে। ওই জমি আবাদ
কইরে আর অটোরিকশা চালায়ে
১০ জনের সংসার একাই
চালাইতাছি। লকডাউনে অটো চালানি বন্ধ।
এহন কোনও বেলায় একবার
খেয়ে, কোনও বেলা না
খায়ে দিন কাটাইতেছি। অনেক
কষ্টের মধ্যেও
তিন পুলারে পরাইতাছি। কিন্তু আমি মইরা গেলে
এই পুলাপানডিরে কে দেখবে? দেখার
মতো আর কেউ নাই।
ওরা গভীর সাগরের মধ্যে
পইরে যাবো। তাই সরকারের কাছে
আমার অনুরোধ, পুলাডিরে যদি কিছু একডা
ব্যবস্থা কইরে দেয় তাইলে
আমি মইরে গেলেও শান্তিতে
থাকমু।’
মা
মোছা. নাছিমা বেগম (৩৬) বলেন, ‘আমার
চারটে ছেলেই জন্মের ২-৩ পর
মাসের মধ্যেই অন্ধ হয়ে যায়।
আমার তো অতো টেকা
নাই। তাও আমি কিছু
কবিরাজ, ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা করাইছি।
আমি চিকিৎসা ঠিকমতো করতেই পাই নেই টাকার
অভাবে। সরকারতো কতভাবে কত টেহাই খরচ
করে। যদি আমার চারটে
পুলারে একটু ভালো চিকিৎসা
করতো। এর মধ্যে দুইডে
ছেলেই চোখে ঠিকমতো দেখতে
পাইতো। তাহলে আমার কইলজেডা ঠান্ডা
হইতো।’
বড়
ছেলে নাজমুল হক বলেন, ‘চার
ভাইয়ের মধ্যে আমিই বড় এবং
বিবাহিত। আমি আমার ছেলেমেয়ের
মুখটাই দেখতে পারতাছি না। আমরা চার
ভাইয়ের মধ্যে যদি একটা ভাই
দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাইতাম। তাহলে
আর তিনটা ভাই চলতে পারতাম।
চোখের দৃষ্টিশক্তিটা ফিরে পেলে ছেলেমেয়ের
মুখটাতো একটু দেখতে পারতাম।
অনেকেই ঘৃণা করে আমাদেরকে।
আমরা সমাজে অবহেলিত। আমি চাই না,
আল্লাহ আর কাউকে অন্ধ
বানাক।’
দ্বিতীয়
ছেলে নয়ন বলেন, ‘আমি
বকশিগঞ্জে গাজী আমানুজ্জামান মডার্ন
কলেজে মানবিক বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয়
বর্ষে পড়াশোনা করি। এসএসসিতে আমি
জিপিএ ৩.৯৪ পেয়েছিলাম।
আমি আর মোফাজ্জ্বল (তৃতীয়
ভাই) যখন এসএসসি পরীক্ষা
দেই, তখন আমাদের শ্রুতিলেখক
ভাড়া করতে মোট ২৯
হাজার টাকা খরচ হয়।
আমরা সাহায্যের জন্য অনেক জায়গায়
গেছি। অনেকেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ওনারা কেউ কোনও সাহায্য
করেননি। পরে আমার বাবা-মা পালের গরু
বিক্রি করে আমাদের টাকা
দিয়েছেন। এখন এইচএসসি পরীক্ষার
জন্যও শ্রুতি লেখক প্রয়োজন। কিন্তু
আমাদের পক্ষে এখন টাকা জোগাড়
করা সম্ভব না। হয়তো অর্থের
অভাবে আমরা এইচএসসি পরীক্ষা
দিতে পারবো না। সরকার যদি
একটু সহায়তা করতো তাহলে আমরা
পরীক্ষা দিতে পারবো।’
তৃতীয়
ছেলে মোফাজ্জ্বল হক বলেন, ‘আমি
বকশিগঞ্জের গাজী আমানুজ্জামান মডার্ন
কলেজে মানবিক বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয়
বর্ষে পড়ি। এসএসসিতে আমি
জিপিএ ৪.৩৯ পেয়েছি।
আসলে সবার মুখেই শুনি
এই পৃথিবীটা নাকি অনেক সুন্দর।
আমার এই জীবনে কখনও
দেখার সুযোগ হয়নি। যদি আমার চোখটা
যদি ফিরে পেতাম, তাহলে
আমার বাবা মায়ের মুখসহ
পৃথিবী যে এতো সুন্দর
সেটা উপভোগ করতে পারতাম।
চতুর্থ
ছেলে আজিম উদ্দিন বলেন,
‘আমি ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি।
আমার ইচ্ছা আছে শিক্ষক হবো।
আসলে শিক্ষকতা ছাড়া আমাদের আর
কোনও চাকরি নেই। তাই আমি
বড় হয়ে শিক্ষক হয়ে
আমার বাবা মাকে আর
কোনও কষ্ট করতে দেবো
না।’
প্রতিবেশী
মোছা. লিজা বলেন, ‘আমরা
আগে কখনও এমন ঘটনা
দেখিনি। এক পরিবারের চারজন
লোক অন্ধ। জন্মের পর থেকে তারা
আস্তে আস্তে অন্ধ হয়ে গেছে।
এই ঘটনা আসলে বিরল।
তারা প্রতিটি ভাই খুব মেধাবী।
মোফাজ্জ্বল অনেক সুন্দর গান
গায়। আমরা সরকারের কাছে
আকুল আবেদন জানাই যে, সরকার যদি
একটু আর্থিকভাবে সহযোগিতা করে। তাহলে এই
পরিবারটা অনেক ভালোভাবে চলতে
পারবে।’
বকশিগঞ্জ
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা
কর্মকর্তা ডা. প্রতাপ কুমার
নন্দী বলেন, ‘আমরা এই চার
ভাইকে একজন আই স্পেশালিস্টের
কাছে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা
করবো। জানার চেষ্টা করবো, কী কারণে তারা
অন্ধত্ব বরণ করেছে। সেটা
পরবর্তী চিকিৎসার মাধ্যমে আবার স্বাভাবিক জীবনে
ফিরিয়ে আনা যায় কি-না এই বিষয়গুলো
খুব দ্রুত দেখবো।’
পরিবারটির
পাশে দাঁড়িয়ে সরকারি সহায়তার কথা জানিয়ে বকশিগঞ্জ
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুন মুন জাহান
লিজা বলেন, ‘একই পরিবারের চারজন
দৃষ্টি প্রতিবন্ধীর মধ্যে নাজমুল ও মোফাজ্জ্বল প্রতিবন্ধী
ভাতা পাচ্ছেন এবং নয়ন ও
আজিম উদ্দিন শিক্ষা উপবৃত্তি পাচ্ছেন। তবুও নয়ন ও
আজিম উদ্দিনের প্রতিবন্ধী ভাতার জন্য কার্ড দেওয়া
হবে।’
তিনি
আরও বলেন, ‘বকশিগঞ্জ উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমরা
সবসময় তাদের পাশে আছি। সরকারের
সুযোগ সুবিধা যেন তারা পায়
এবং সমাজে যেন তারা পিছিয়ে
না থাকে, সে জন্য উপজেলা
প্রশাসন সবসময় তৎপর আছে।’