ফ্রিডম বাংলা নিউজ

বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ২১, ২০২৪ |

EN

কোটি মানুষকে নিরাপদে আঁগলে রাখা সুন্দরবন নিজেই ভালো নেই

ফ্রিডমবাংলানিউজ ডেস্ক | আপডেট: রবিবার, ফেব্রুয়ারী ২০, ২০২২

কোটি মানুষকে নিরাপদে আঁগলে রাখা সুন্দরবন নিজেই ভালো নেই
সুন্দরবন বিশ্বের প্রাকৃতিক বিস্ময়াবলীর অন্যতম প্রশস্ত বনভূমি। লোনা পরিবেশের ম্যানগ্রোভ বন হিসেবে বিশ্বের সর্ববৃহৎ অখন্ড বনভূমি এই সুন্দরবন। ১৪ ফেব্রুয়ারী দিনটিকে যুগ যুগ ধরে সারাবিশ্বে ভালবাসা দিবস হিসেবে পালন করা হলেও জীববৈচিত্র সংরক্ষণে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে সুন্দরবন উপকূলীয় পাঁচ জেলার মানুষ ২০০১ সাল থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারী দিনটিকে ‘সুন্দরবন দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছেন। এরই ধারাবাহিকতায় ভালবাসা দিবসে ভালবাসুন সুন্দরবনকে প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে এবারে পালিত হলো ২১তম সুন্দরবন দিবস। প্রতিটি ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস সহ নানা প্রকৃতিক দুর্যোগে নিজে ক্ষতবিক্ষত হয়ে মাতৃ ছায়ায় উপকূলীয় কোটি-কোটি মানুষকে নিরাপদে আঁগলে রাখা সেই সুন্দরবন নিজেই এখন ভালো নেই। 

জলবায়ু পরিবর্তনে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি, পরিবেশ দূষণ, জীববৈচিত্র ধ্বংসকারী চোরা শিকারি ও কাঠ পাচারকারীদের কারণে ম্যানগ্রোভ এই বন আজ অস্তিত্ব সংকটে। যদিও বনবিভাগ বলছে, আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর স্মার্ট প্যাট্রোলিংসহ সুন্দরবনের প্রাণপ্রকৃতি সুরক্ষায় সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। বন বিভাগের দেওয়া তথ্য মতে, ২০০১ সাল থেকে সুন্দরবনে অদ্যাবধি ৫৫টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে। যারমধ্যে স্বাভাবিকভাবে মৃত্যু হয়েছে মাত্র ১৭টির। চোরাশিকারিদের বাঘ শিকার নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এক শ্রেণির জেলেরা আবার সুন্দরবনের মৎস্য ভান্ডারকে ঠেঁলে দিয়েছে মারাত্মক হুমকির মুখে। কেননা তারা স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি মাছ ধরতে খালে বিষ প্রয়োগ করে মৎস্য আহরণ করে থাকে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব পড়েছে সুন্দরবনে। উজান থেকে মিষ্টি পানির প্রবাহ না থাকায় জলবায়ু পরিবর্তনে সমুদ্রে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাঁড়াও পূর্ণিমা ও অমাবস্যার জোয়ারে সুন্দরবনের সব থেকে উঁচু এলাকা করমরজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রে ২ থেকে ৩ ফুট পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। এতে করে নষ্ট হচ্ছে নানা প্রজাতির বন্যপ্রাণীর ডিম। 

করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাওলাদার আজাদ কবির জানান, পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় কুমিরসহ যেসকল বন্যপ্রাণী ডিম থেকে বাচ্চা ফুটিয়ে বংশবিস্তার করে তা ব্যাহত হচ্ছে। 

সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও সুন্দরবন গবেষক ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, সুন্দরবনের উপর পর্যটকদের চাপ কমানোসহ ইসিএ ভূক্ত এলাকায় নতুন করে শিল্প কলকারখানা নির্মাণ বন্ধ করতে হবে। এই ম্যানগ্রোভ বনে লোকবলসহ নৌযানের সংখ্যা বৃদ্ধি, বনের ওপর জীবিকায় নির্ভরশীলদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাসহ চোরাশিকারি, কাঠপাচারকারী ও বনে আগুন দিয়ে সম্পদ লুটকারীদের দমন করতে পারলেই বহুলাংশে রক্ষা পাবে সুন্দরবনের প্রাণপ্রকৃতি। 

বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন নানা সংকটের মাঝেও আশার কথা জানিয়ে বলেন, আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর স্মার্ট প্যাট্রোলিংসহ সুন্দরবনের প্রাণপ্রকৃতি সুরক্ষার সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো হচ্ছে। পাশাপাশি ১৫৭ কোটি টাকা ব্যয়ে সুন্দরবন সুরক্ষা প্রকল্পের কাজ শুরু হলে দ্রুতই পুনঃরায় সব বন্যপ্রাণীর জরিপ কাজ শুরু হবে। বন্যপ্রাণীর সুপেয় পানির চাঁহিদা মেটাতে আগামী জুন মাসের মধ্যে ৮৪টি পুকুর খনন ও পুনঃখনন কাজ শুরু হবে। পাশাপাশি অধিক ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করে সুন্দরবনকে সুরক্ষিত করা হবে বলেও জানান তিনি। 

উল্লেখ্য, সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের আয়তন প্রায় ৬ হাজার ১৭ বর্গ কিলোমিটার। ২৪ ঘণ্টায় ৬ বার প্রাকৃতিক রূপ বদলানো সুন্দরবনের মোট আয়তনের ৫২ ভাগই এখন ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অংশ। বনের মোট আয়তনের ৩১ দশমিক ১৫ ভাগই হচ্ছে জলাভূমি। বিশ্বের সর্ববৃহৎ এই জলাভূমি ‘রামসার’ এলাকা হিসেবে স্বীকৃত। বিশ্বের অন্যান্য ম্যানগ্রোভ বনের তুলনায় সুন্দরবনের জীববৈচিত্র আবার অধিকতর সমৃদ্ধ। সুন্দরীসহ এই বনে রয়েছে ৩৩৪ প্রজাতির গাছপালা, ১৬৫ প্রজাতির শৈবাল ও ১৩ প্রজাতির অর্কিড। বাঘ, হরিণ, কুমির, কিংকোবরা, বিলুপ্তপ্রায় ইরাবতিসহ ৬ প্রজাতির ডলফিন, ৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণী ও ২১০ প্রজাতির মৎস্য সম্পদ। সুন্দরবন সকল ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের মতো নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে যেমন ক্ষতবিক্ষত হয়ে মাতৃ ছায়ায় উপকূলীয় কোটি-কোটি মানুষসহ দেশকে আঁগলে রাখে তেমনি এ জনপদের লাখ-লাখ মানুষের জীবিকা নির্বাহের অবলম্বন হিসেবেও কাজ করে।

লেখক: মহানন্দ অধিকারী মিন্টু