ফ্রিডম বাংলা নিউজ

রবিবার, মার্চ ১৬, ২০২৫ | ২ চৈত্র ১৪৩১

EN

৪১ বছরে সাড়ে ৮ হাজার মৃত্যুর মাইকিং

শোক সংবাদের ফেরিওয়ালা ফকির আলী।

মেহেদী হাসান, ফুলবাড়ী, দিনাজপুর | আপডেট: সোমবার, ফেব্রুয়ারী ১৪, ২০২২

শোক সংবাদের ফেরিওয়ালা ফকির আলী।
একটি শোক সংবাদ...এই সংবাদটি মাইকে বাজার সাথে সাথেই উৎকীর্ণ হয়ে উঠেন সকলে। কে যে মারা গেল! কোন অভাগা-অভাগিনীর  প্রিয়জন এই ধমনি থেকে বিদায় নিল। মর্মান্তিক এই খবরটি সবার কাছে মাইকে প্রাচারের মাধ্যমে পৌঁছে দেন ফকির আলী।

দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার পৌর শহরের পশ্চিম গৌরীপাড়া গড় ইসলামপুর গ্রামের মৃত হযরত আলী'র ছেলে মো. নুরুল ইসলাম (৬১)। ডাক নাম ফকির আলী। এলাকর সকল শ্রেনি পেশার মানুষ তাকে ফকির আলী নামেই চেনেন। তিনি রিশকা চালানোর পাশাপাশি মাইকে মৃত্যুর সংবাদ প্রচার করে জীবিকা নির্বাহ করেন।

তার এই দরাজ গলায় শোক সংবাদ শোনার জন্য অনেকে প্রস্তুত থাকেন না। কিন্তু নিয়তির নির্মমতায় কোন কোন দিন তাকে দুই থেকে তিন টি শোক-সংবাদ মাইকে প্রচার করতে হয়। তখন অনেকেই যেন এই ফকির আলীকে নতুন নামে আবিষ্কার করে, দির্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, আজ ফকির আলীর গুরুত্ব বেড়ে গেছে।

ফুলবাড়ী পৌর শহরের স্থানীয় নিমতলা মোড়ে রাস্তার পাশে রিশকা নিয়ে দাড়ীয়ে থাকা অবস্থায় কথা হয়, ফকির আলীর সাথে,তিনি বলেন, ১৯৭৫ সাল থেকে তিনি রিক্সায় যাত্রী টানেন। আশির দশকের পর থেকেই ফকির আলী মানুষের মৃত্যুর সংবাদ মাইকিং করে আসছেন। এখন গুরুত্ব বেড়ে গেছে। প্রতিদিন দিন খোঁজ না হলেও,আবার কোনো কোনো দিন ৩/৪ টির বেশি সময় মেইনটেইন করে মৃত্যুর সংবাদ মাইকে প্রচার করেন। ভাড়া নির্ধারণ কীভাবে করেন তার উত্তরে তিনি বলেন, এটি একটি মানবিক কাজ। কখনো নিদৃষ্ট ভাড়া ঠিক করি না। কাজ শেষে যে যার ইচ্ছেমতো সামর্থ অনুযায়ী ৫ শ' থেকে হাজার, এক হাজার টাকা দিয়ে থাকেন। প্রচার শেষে কেউ কেউ সপ্তাহ, দুই সপ্তাহ পার করেও টাকা দেন। মাসে ১৫/ ২০ টি করে মাইকিং করা হয় । মাসে গড়ে ১৭ টি হিসেবে ৪১ বছরে প্রায় সাড়ে আট হাজার মৃত্যুর সংবাদ মাইকিং করেছেন বলে জানান ফকির আলী। 

 এপেশা থেকেই তার সংসার চলেনা,পাশাপাশি রিকশা চালান। স্থানীয় নিমতলা মোড় তার আসল ঠিকানা। সবাই জানে এই ফকির আলীকে কোথায় পাওয়া যায়। তবে সব মাইকের দোকানে তার মোবাইল নম্বর দেয়া আছে। যখন মাইকিংয়ের কাজ থাকেনা তখন রিক্সায় ভাড়া খাটেন। তবে দিন-রাতের বেশিরভাগ সময়ে তাকে তটস্থ থাকতে হয়, কখন মৃত্যুর খবর আসে !

মাইকিং করতে মাইক এবং একটি রিক্সা ভাড়া করে নিতে হয়,তা থেকে সব খরচ বাদে যা আায় হয়, সেই টাকা দিয়ে স্ত্রী,এক ছেলে, দুই মেয়ে সহ পাচঁ সদস্যের সংসারের খরচ যোগাতে হয়। যদি কেউ মাইক অথবা রিক্সা দিয়ে সহযোগিতা করতো তাহলে আমি কমটাকায়, স্বাচ্ছন্দে, সময়মতো এই মানবিক কাজটি করতে পারতাম।

রিক্সা চালক আসাদুল,দয়াল সহ অনেকে জানান, আমরা একসাথেই রিক্সা চালাই। আমাদের আত্মীয় স্বজনদের মৃত্যুতে এই ফকির আলী মাইকিং করে থাকেন। কখনো টাকা নিয়ে তার তেমন বেশি চাহিদা নেই।

ফুলবাড়ী দারুস সুন্নাহ সিদ্দিকিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মো. শাহাদাত আলী বলেন, আমার সহকর্মী অধ্যাপক মঈনুদ্দীন মারা গেলে মাইকিং করার জন্য ফকির আলীকে খবর দেই। দ্রুত হাজির হয়ে অসুস্থ্য শরীরেই, রাতের ঠান্ডা উপেক্ষা করে মাইকিং করেন ফকির আলী।

ফুলবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. মুশফিকুর রহমান বাবুল বলেন, দির্ঘদিন ধরে ফকির আলী ফুলবাড়ীর দল-মত নির্বিশেষে মৃত্যুর সংবাদ প্রচার করে আসছেন। এটি অত্যন্ত একটি ভালো কাজ।

ফুলবাড়ী পৌরসভার পৌর মেয়র মাহমুদ আলম লিটন বলেন, দুঃসময়ে দূরবর্তী মানুষকে ডাকা নিঃ সন্দেহে উত্তম কাজ। ফকিরআলী সেই কাজটি করেন। আমার বাপ দাদা ভাইয়ের মৃত্যুতে তিনিই মাইকিং করেছেন। যে কোনো সমস্যায় আমি তার পাশে থাকবো।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. রিয়াজ উদ্দিন বলেন,আমার জানামতে ফকির আলী অনেকদিন থেকে মৃত্যুর সংবাদ প্রচার করে আসছেন । নিশ্চয়ই এটি একটি মহতী কাজ ।

ফুলবাড়ী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আতাউর রহমান মিল্টন বলেন,আমি ছোট বেলা থেকেই শুনে আসছি মৃত্যুর সংবাদ মাইকিং করেন ফকির আলী। এই মানবিক কাজ করার জন্য তাকে সহযোগিতা করা দরকার।