পিতামাতার কোনো ক্লান্তি নেই। সন্তান মানুষ করতে জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বির্সজন দিয়েছেন অবলীলায়। কিন্তু একটা সময় আসে যখন তাদের অনেককেই একাকিত্বের মতো কষ্টকর জীবন কাটাতে হয়। ভুগতে হয় অর্থকষ্টেও। এ ধারা অনেক দিন ধরেই চলছে। তবে সম্প্রতি বিষয়টি আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে। এক্ষেত্রে অসহায় মানুষগুলোর ভরসার জায়গা হয়ে উঠেছে বৃদ্ধাশ্রমগুলো।
এ পরিস্থিতিতে প্রতিবছরের মতো এবারও এসেছে বিশ্ব প্রবীণ দিবস। ১ অক্টোবর বিশ্ব প্রবীণ দিবস। দিবসটি উপলক্ষ্যে প্রবীণদের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে নানা আঙ্গিকে আলোচনা হয়। তারপর সব ফের আগের মতোই। যেমন চলার, চলে তেমনই। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য-‘সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণায় প্রবীণদের জন্য প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি পূরণে প্রজন্মের ভূমিকা’।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে-বিদেশে সর্বত্র আজ বার্ধক্যে উপনীত মানুষ চরম অসহায়। মা-বাবা সন্তানকে মানুষ করেন, সঞ্চয় বিলিয়ে দেন। যাদের অল্পবিস্তর অর্থ আছে, তারা জীবনের শেষ পর্যায়ে বৃদ্ধাশ্রমে অতিবাহিত করেন। চোখে জল নিয়ে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করেন। আর যারা সন্তানকে সবকিছু দিয়ে নিঃস্ব, তাদের স্থান হয় খোলা আকাশের নিচে।
বাংলাদেশের আইনে সুনির্দিষ্ট ভাবে উলেখ করা হয়েছে, প্রত্যেক বয়স্ক নাগরিকের মর্যাদাসহ বেঁচে থাকার অধিকার আছে। এই অধিকার লঙ্ঘিত হলে প্রশাসন উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। কিন্তু, প্রবীণরাই নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন নন। প্রবীণরাই প্রস্তুত নন। যার ফলে জীবনের শেষ পর্যায় বৃদ্ধাশ্রমে অতিবাহিত করেন। চোখে জল নিয়ে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করেন।
বাংলাদেশে প্রবীণদের অবস্থা ৬০ বছরের বেশি বয়সি মানুষকে প্রবীণ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে এ সংখ্যা ১ কোটি ৫০ লাখের বেশি। ২০২৫ সাল নাগাদ এই সংখ্যা দাঁড়াবে ১ কোটি ৮০ লাখে আর ২০৫০ সাল নাগাদ হবে প্রায় সাড়ে ৪ কোটি। তথ্য বলছে, দেশে সরকারি ভাবে কোনো বৃদ্ধাশ্রম নেই।
সরকারি ভাবে প্রবীণ নিবাস থাকলেও সেইসব নিবাসে টাকা দিয়ে থাকতে হয়-খেতে হয়। আবার যেগুলো বেসরকারি পর্যায়ে রয়েছে, সেগুলো পরিচালনাসংক্রান্ত কোনো রূপরেখাও নেই। তবে বেসরকারি পর্যায়ে থাকা বৃদ্ধাশ্রমগুলো আর্শীবাদ বলে জানাচ্ছেন-নিঃস্ব মানুষগুলো।
দেশের বিভিন্ন স্থানে বৃদ্ধাশ্রম গড়ে উঠছে। সংশ্লিষ্টদের চেষ্টার কমতি নেই। অধিকাংশ বৃদ্ধাশ্রম সাধারণ মানুষের আর্থিক সহযোগিতায় চলছে। কিন্তু সেই বৃদ্ধাশ্রমে বয়স্ক নাগরিকরা কীভাবে বেঁচে আছেন, কেউ জানে না। আপনজনওরা খোঁজখবর নেয় না। এমন একটি নিবাসে গিয়ে কথা হয় বেশ কয়েকজন প্রবীণের সঙ্গে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন জানান, তারা নিঃসঙ্গ জীবন অতিবাহিত করছেন এবং প্রতীক্ষায় আছেন, কবে মৃত্যু এসে তাদের নিষ্কৃতি দেবে। বললেন, সন্তানের শূন্যস্থান কী কেউ পূরণ করতে পারে।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ের বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ ও জরাবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানে প্রায় অর্ধশতাধিক প্রবীণ নারী ও পুরুষ রয়েছেন। এদের সবাই নির্ধারিত অর্থ দিয়ে থাকেন-খাবার খান। কেউ সাধারণ পরিবারের নন। কেউ সরকারের উচ্চপর্যায়ে, কেউ বা বড় ব্যবসায়ী ছিলেন। কেউ আবার মানুষ গড়ার কারিগর ‘শিক্ষক’ ছিলেন। এদের সন্তানদের কেউ কেউ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডাসহ উন্নত রাষ্ট্রে বসবাস করছেন। কেউ দেশেই প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু, জন্মদাতা মা-বাবাকে দেখছেন না। নিচ্ছেন না খোঁজও।
একটি বেসরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা জানান, এ নিবাসেই হয়তো তার মৃত্যু হবে। স্বামী পুলিশের কর্মকর্তা ছিলেন। দুই সন্তানের মধ্যে একজন কানাডা অন্যজন আমেরিকা থাকে। একজন শাশুড়ি নিয়েই থাকে। দেশে এলেও তার খোঁজ নেয়নি। সন্তানদের জন্য কি কষ্ট হয়? নিশ্চয়, এ বয়সে প্রার্থনায় থাকতে হয় বেশি। প্রার্থনা করি সন্তানরা যেন সব সময় ভালো থাকে।
নিবাসটিতে সাবেক এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ৯ বছর ধরে থাকছেন। জানালেন, স্ত্রী মারা গেছেন। ১ মেয়ে, ২ ছেলের মধ্যে সবাই দেশের বাইরে। সম্পত্তি বিক্রি করে পড়াশোনা করিয়েছেন। সম্পত্তি লিখে দিয়েছেন। তার বলতে এখন কিছুই নেই। ভেবে ছিলেন সন্তানরাই তার সম্পত্তি। এ নিবাসে থাকেন-খাবার খান। কিন্তু সন্তানদের শূন্যস্থান কী কখনও কেউ পূরণ করতে পারে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ বিভাগের অধ্যাপক এএসএম আতিকুর রহমান গত চার দশক ধরে বাংলাদেশের প্রবীণ জনগোষ্ঠীকে নিয়ে নানা গবেষণা করছেন।
তিনি জানান, বার্ধক্য মানুষের জীবনে আসে-আসবে, এটা যেন সবাই ভুলেই থাকেন। কিন্তু এ বার্ধক্যই মানুষকে নিঃস্ব করে দেয়। সমাজ পরিবার থেকে বঞ্চিত হয়। প্রবীণদের কষ্টের কোনো সীমা নেই, বিশেষ করে নারী প্রবীণদের ক্ষেত্রে এটি আরও বেশি। সন্তানদের জন্য সম্পদ রেখে যাওয়া নয়, সন্তানদের সুশিক্ষায় সম্পদ করে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। বৃদ্ধ অবস্থায় পিতা-মাতাকে সন্তানের কাছ থেকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য ২০১৩ সালে ‘পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন’ প্রণয়ন করে সরকার। পিতা-মাতার ভরন-পোষণ না করলে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে এই আইনে।