ফরিদপুর জেলা শহর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরেই সদরপুর উপজেলার সদর ইউনিয়নের আটরশি-পুকুরিয়া সড়কের পাশে জরাজীর্ণ অবস্থায় দাড়িয়ে থাকা বাড়িটির নাম বাইশ রশি জমিদার বাড়ি। কালের সাক্ষী হয়ে আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বাড়িটি। বিভিন্ন এলাকা থেকে বাড়িটি দেখার জন্য অনেকইে ছুটে আসেন।
এককালে যাদের ছিল জাঁক জমকপূর্ণ বিলাস বহুল জীবনযাত্রা জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের পর তারা এ এলাকা ছেড়ে চলে যান। জমিদারদের এককালের দালান কোঠার ধ্বংসাশেষ এখনো কালের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। এর ইট সুরকি খসে খসে পড়ছে। খসে যাওয়া দালানটির ইটের ফাঁকে ফাঁকে এখন গজিয়েছে ডুমুর ও বট বৃক্ষ আর জমেছে শেওলার আস্তরণ।দর্শনার্থীরা জমিদারবাড়ির ভগ্নাংশ দেখে দুঃখ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এদিকে জমিদার বাড়িটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সবরকম প্রচেষ্টা গ্রহণের আশ্বাস দেন উপজেলা প্রশাসন।
স্থানীয় সূত্র থেকে জানতে পারি, ১৮ শতকের শুরুর দিকে প্রতাবশালী বাইশরশি জমিদাররা ফরিদপুর-বরিশালসহ ২২টি পরগনার বা জোত মহলের অধিপতি ছিলেন। সুকুমার চন্দ্র রায় বাহাদুর উপজেলার বাইশরশি গ্রামে এই বিশাল বাড়িটি নির্মাণ করেন। প্রায় ৫০ একর জমি নিয়ে জমিদার বাড়িতে বাগানবাড়ি, ৫টি শান বাঁধানো পুকুর, ২ পূজামন্ডপ ও দ্বিতলা বিশিষ্ট ছোট-বড় ১৪টি দালান কোঠা দিয়ে ঢেলে সাজিয়ে ছিলেন।
জানা যায়, ১৭শ শতাব্দীর গোড়াপত্তনে এককালের লবণ ব্যবসায়ী সাহা পরিবার বিপুল অর্থসম্পত্তির মালিক হয়ে কয়েকটি জমিদারি পরগনা কিনে জমিদারি নেন। ১৮শ শতক থেকে ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের আগে জমিদার পরিবারটি অনেক ধন-সম্পত্তির মালিক হন এবং বিশাল জমিদার হিসেবে ভারতবর্ষে খ্যাতি লাভ করেন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান-ভারত বিভক্তির হওয়ার পর ১৯৪৭ থেকে ১৯৬২ সালে জমিদারি প্রথা থাকার আগ পর্যন্ত জমিদাররা কলকাতা বসে জমিদারি পরিচালনা করত। জমিদারি প্রথা বাতিল হওয়ার পর জমিদার সুকুমার রায় বাহাদুর ছাড়া সবাই কলকাতা চলে যায়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সুকুমার বাবু আত্মহত্যা করেন। এরপর বাড়িটিতে আর কোন অভিভাবক না থাকায় পরিত্যক্ত হয়ে যায়। বর্তমানে বাড়িটির চারপাশের অনেক জমি ভূমিদস্যুরা দখল করে নিয়েছে। প্রতিনিয়ত চুরি হয়ে যাচ্ছে মূল্যবান দরজা-জানালা, লোহার কারুকার্য খচিত প্রত্নতত্ত্ব। রাতের বেলা এ বাড়িটি হয়ে উঠেছে চোর ডাকাতদের ও মাদকসেবীদের অভায়ারণ্য। এ ব্যাপারে স্থানীয় জনসাধারণ সরকারের নিকট আবেদন জানিয়েও প্রতিকার পাচ্ছে না।
স্থানীয়দের দাবী, সরকারের তত্ত্বাবধানে এ বাড়িটি রক্ষনাবেক্ষণ করে একটি পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন করা হলে এলাকার পরিচিতি আরো বৃদ্ধি পাবে। এটা ফরিদপুর জেলার একটি মূল্যবান সম্পদ। বাড়িটিকে পুনরায় সংস্কার-সংরক্ষণ করে একটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেকে গড়ে তোলার জোর দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
বাইশরশি জমিদার বাড়িতে অবস্থিত সদরপুর উপজেলা ভূমি অফিসে কর্মরত নাজির কাম কম্পিউটার অপারেটর গোকুল চন্দ্র বলেন, এই জমিদার বাড়িতে পহেলা বৈশাখ, ঈদসহ নানা অনুষ্ঠানে জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে হাজার হাজার পর্যটক আসে। এখানে বিশেষ দিন গুলোতে বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান হয়। সরকার এই বাড়িটি সংস্কার করে একটি পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন করা হলে ফরিদপুরের ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ব্যাপক ভাবে জানতে পারবে।
সদরপুর উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাজী শফিকুর রহমান জানান, এ অঞ্চলের নিজস্ব সংস্কৃতি ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে বাইশ রশি জমিদার বাড়িটি রক্ষণাবেক্ষণের দাবি জানাই। এলাকাবাসী জমিদার বাড়িটি সংস্কার ও প্রয়োজনীয় মেরামতের জন্য এর আগে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জোর দাবি জানিয়েছে।
সদরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ আহসান মাহমুদ রাসেল বলেন, বাইশরশি জমিদার বাড়িতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ ঘুরতে আসে। এটি ফরিদপুরের একটি অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। আমি বাড়িটির ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলব যাতে বাড়িটি একটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব হয়।