ফ্রিডম বাংলা নিউজ

শনিবার, এপ্রিল ২০, ২০২৪ |

EN

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ১০ বছর আজও কান্না থামেনি রেবেকা’র

মেহেদী হাসান, ফুলবাড়ী, দিনাজপুর | আপডেট: বুধবার, এপ্রিল ২৬, ২০২৩

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ১০ বছর আজও কান্না থামেনি রেবেকা’র
এই তো গতকালই ছিল ঈদের দিন, সবাই তাদের স্বামী সন্তান নিয়ে ঘুরছে, এমনি এক হতভাগ্য আমি পারিনি আমার সন্তানদের নিয়ে কোথাও বের হতে। ঘুরে ফিরে বাড়ীতেই। আর সন্তানরাও আমাকে নিয়ে যেতে পারছে না কোথাও। স্বামী, সন্তানদের প্রয়োজনে তাদের কাছেও যেতে পারিনা।

হয়তো কিছু টাকা পেয়েছি, কেউ একটা বাড়ী করে দিয়েছে, কিন্তু কেউ কী আমার পা দু’টো ফিরিয়ে পারবে? যা দিয়ে আমি আগের মতো স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে পারবো!  কান্না জড়িত কন্ঠে কথাগুলো বলছিলেন ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ঢাকার সাভারে রানা প্লাজাধ্বসে দু’পা হারানো দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার পঙ্গু পোশাক শ্রমিক রেবেকা খাতুন।

দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার আলাদীপুর ইউনিয়নের বারাই চেয়ারম্যানপাড়া গ্রামের রাজমিস্ত্রি মোস্তাফিজার রহমানের স্ত্রী রেবেকা খাতুন।

রোববার (২৩ এপ্রিল) দুপুরে কথা হয়, রানা প্লাজায় দূর্ঘটায় দু’পা হারিয়ে পুঙ্গত্ব বরণকারী পোশাক শ্রমিক রেবেকা খাতুন এবং একই ঘটনায় নিখোঁজ হওয়া উপজেলার কাজিহাল ডাঙ্গা গ্রামের গুলশান আক্তার শাবানার পরিবারের সাথে।

আজ ২৪ এপ্রিল ভয়াবহ রানা ট্র্যাজেডির ১০ বছরপূর্ণ হলো। সেদিনের ভয়াবহ দূর্ঘটানায় দু’পা হারিয়ে পঙ্গুত্ববরণকারী পোশাক শ্রমিক রেবেকা সেই ভয়াল দুঃসহ স্মৃতি বহণ করছে এখোনো, আজও কাঁন্না থামেনি তার। রানা প্লাজার ঘটনায় হারানো দু’পায়ে জরুরী অপারেশন করার প্রয়োজন ছিল; কিন্তু করতে পারেনি। এখন বেশী চলা ফেরা করলেই পা ব্যাথা করে।

রেবেকা বলেন, ঘটনার আগের দিন অর্থাৎ ২৩ এপ্রিল রানা প্লাজায় ফাটল দেখে শ্রমিকরা কতৃপক্ষকে জানালে বিকেল ৪টায় ছুটি দিয়ে দেন তাদের। পরেরদিন সকাল ৮টায় যথারিতী কাজে এসে বিল্ডিং-এর ফাটলের কারণে কাজে যোগ দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে, রানা প্লাজা কর্তৃপক্ষ হুমকি দিয়ে বলেন, বেতন-ভাতাসহ অভারটাইমের টাকা দেয়া হবে না সেইসাথে চাকুচ্যুত করা হবে।বকেয়া টাকা এবং চাকুরি হারাবার ভয়ে সব শ্রমিকের সাথে রেবেকাও কাজে যোগ দেয় সেদিন। ঘটনার দিন সকাল ৯টায় তার মা নিখোঁজ চান বানু নাস্তা খাওয়ার কথা বললে,রেবেকা বলে, একটু কাজ আছে তা শেষ করে পরেই খাব মা।

কিন্তু নিয়তির কি পরিহাস,এরপর তিনদিন আর খাবার মুখে জোটেনি  রেবেকার । দুর্ঘটনায় অচেতন হয়ে ৩দিন আটক পড়ে ছিল ওই বিল্ডিং-এর ধ্বংসস্তুপের নিচে। জ্ঞান ফিরলেই ‘তৃষ্ণায় বুক ফেটে গেলেও পাইনি পানি, তখন নিজের গায়ের ঘাম শুষে নেয়াসহ নিজের মুত্র পান করতে হয়েছে। পরে উদ্ধার কর্মীরা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করায়। এরপর নিজেকে হাসপাতালে আবিস্কার করে তিনি। আরও পরে জানাতে পারে তার শরীরে অপরিহার্য্য দু’টি পা নেই। এরই মধ্যে তার দু’পায়ে ৮বার অপারেশন করা হয়েছে। দীর্ঘ এক বছর ঢাকাস্থ পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে কর্মহীন হয়ে গ্রামে ফিরে আসেন তিনি। রেবেকা বলেন, সবচেয়ে কষ্টের বিষয় হলো ওই দিন আমি আমার গর্ভধারিনি মা চান বানু ও দাদী কোহিনুর বেওয়াকেও হারিয়েছি, তাদের মরদেহ আজও খুঁজে পায়নি। আমার জীবন থেকে
যাকিছু হারিয়ে গেছে তা আর ফিরে পাবোনা।
এদিকে এরই মধ্যে তার পঙ্গুত্ব জীবন জুড়ে আসে প্রথম সন্তান ছিদরাতুন মুনতাহা নামে একটি কন্যা সন্তান, বর্তমানে তার বয়স ৯ বছর চলছে। স্থানীয় বারাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে সে। পরে  একটি ছেলে সন্তানের জন্ম হয়,তার নাম মাদানী আন-নুর তার বয়স তিন বছর। পঙ্গুত্বর কারণে সন্তানদের পুরো সময় দিতে পারেন না, ইচ্ছে করে অন্য মায়েদের মতো নিজের সন্তানদের করতে পারে না আদর যত্ন। কিংবা স্বামীর প্রয়োজনে কাজে আসতে পারেন না তিনি।
একটি বেসরকারি সংস্থা তার দু’টি কৃত্রিম পায়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। কোথাও গেলে ওই পা লাগিয়ে শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করা একটু কষ্টকর হলেও অভাবে চলতে হয়। স্বামী ছাড়া তেমন চলাফেরা বা কোন কাজ করতে পারেন না তিনি। ২০২১ সালে ৫ শতাংশ জমিতে বারাই হাট এলাকায় বেসরকারি সংস্থা একটি পাকা টিনসেডের বাড়ি করে দিয়েছেন। কিন্তু সেখানেও বসবাস করতে পারেন না তিনি, কারণ ফাকা জায়গা আশপাশে তেমন বাড়ীঘর নেই এবং স্বামীর অবর্তমানে দেখা শুনা করারমত কেউ না থাকায় থাকেন আগের মাটির বাড়ীতেই।
আক্ষেপ করে রেবেকা খাতুন আরো বলেন, একজন কর্মক্ষম মানুষ এভাবে চলতে পারে না। পা হারিয়ে আজ কর্মহীন হয়ে সারা দিন বাড়ীতে বসে কাটাতে হয়। স্বামী সন্তানের প্রয়োজনেও তেমন কাজে আসতে পারি না। “হয়তো কিছু টাকা পেয়েছি, কেউ একটা বাড়ী করে দিয়েছে, কিন্তু কেউ কী আমার পা দু’টো ফিরিয়ে দিতে পারবে? যা দিয়ে আমি আগের মতো স্বাভাবিক ভাবে হেটে-চলা করতে পারব?

রেবেকা খাতুন এর স্বামী মোস্তাফিজার রহমান বলেন,ওই দুর্ঘটনার পর থেকে আমার স্ত্রী রেবেকা একা চলাফিরা করতে পারেনা,আমাকেই স্ত্রীসহ সন্তানদের দেখাশুনা করতে হয়। সেকারনে আর কাজ করতে পারিনা।নিয়ম অনুযায়ি দুই পা হারানোরা; ক্ষতিপুরণ বাবদ ১৫ লাখ টাকা পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেই সময় চিকিৎসা জনিত ভুল তথ্যের কারণে ক্ষতি পুরণের ৫ লাখ টাকা কম পেয়েছি। ১৫ লাখ টাকার স্থলে পেয়েছি ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র।

 ক্ষতিপুরনের  সেই ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র পেয়েছি, সেই সঞ্চয়পত্রের লোভ্যাংশ হিসেবে প্রতিমাসে যা পাই,তা দিয়েই বর্তমানে আমাদের সংসার চলছে।

তিনি বলেন,আগে আমি কাজ করতাম,সেও কাজ করতো,আমাদের সংসারে সচ্ছলতা ছিল। একটি দুঘটনায় আজ আমাদের সংসার তছনছ হয়ে গেল।

আমরা ওই গামেটর্স মালিকের শাস্তি চাই।

অপরদিকে সেদিনের একই ঘটনায় নিখোঁজ হয় উপজেলার কাজিহাল ইউনয়নের ডাঙ্গা গ্রামের আতাউর রহমানের স্ত্রী পোশাক শ্রমিক গুলশান আক্তার শাবানা।

জানতে চাইলে স্বামী আতাউর রহমান বলেন, প্রতিদিনের মতোই শাবানা ওইদিন রানা প্লাজায় কাজ করতে যায়। ঘটনার পর আর তার কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। তবে নিখোঁজ তালিকায় শাবানার নাম ছিল। নিখোঁজ তালাকার সুত্র ধরে সেই সময় ১৩ লাখ টাকা ক্ষতি পুরণ পেলেও পায়নি স্ত্রীকে কিংবা তার মরদেহ।

প্রসঙ্গত ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজাধস বিশ্বের সবচেয়ে বড় শিল্প দুর্ঘটনার একটি। এতে ১১৩৮ জন পোশাক শ্রমিকের করুণ মৃত্যু ঘটে; আহত হন আরও শ্রমিক। মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনায় পুরো ব