প্রযুক্তির ছোয়ায় বদলে গেছে সারাবিশ্বে বদলে গেছে দেশ। আমরা কথায় কথায় বলে থাকি সারা বিশ্ব এখন হাতের মুঠোয়। এটি সম্ভব হয়েছে প্রযুক্তির সুফলে। অর্থাৎ মুঠোফোন বা বিভিন্ন ডিভাইসের মাধ্যমে স্বল্প সময়ে পৃথীবি জুড়ে কোথায় কী ঘটছে তা আমরা মুহুর্তের মধ্যেই জানতে পারি এবং তথ্য আদান প্রদান করতে পারি। এমনি এক প্রযুক্তির মাধ্যমে দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার৭টি ইউনিয়নের গ্রামীন জনপদে,অতি প্রয়োজনীয় ২৭টি সেবা মিলছে ডিজিটাল ডিভাইসের “অনলাইন সার্টিফিকেট সিসটেম” নামক একটি এ্যাপসের মাধ্যমে। যা দেশের অন্য কোন উপজেলায় এই ব্যবস্থা নেই বলে দাবী সংশ্লিষ্টদের ।
জানাগেছে, বর্তমানে উপজেলা শহরের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ইউনিয়ন গুলো। হাতের মুঠোও সব মিললেও কিছু সেবা পেতে সময় লাগত। গ্রাম পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা প্রত্যায়ন, ট্রেড লাইসেন্স, উত্তরাধিকার সনদ, মৃত সনদ, মাসিক আয়ের সনদ, পরিবেশ ছাড়পত্রের মতো বিভিন্ন সেব পেতে গ্রামের লোকজনকে প্রথমত এলাকার ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যদের বলতে হয়। তারপর ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে আবেদন করে চেয়ারম্যানের স্বাক্ষরের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। এতে করে সময়ক্ষেপনসহ নানা ধরনে ঝাক্কিঝামেলা লেগেই থাকে। তাতে করে গ্রামের মানুষদের সময় মত সেবা পেতে বিলম্ব হয়।
এইসব ঝামেলা এড়াতেই দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার বিদায়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বর্তমান পঞ্চগড় জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. রিয়াজ উদ্দিন, উদ্ভাবন করেছেন “অনলাইন সার্টিফিকেট সিসটেম” নামাক একটি অ্যাপস। যার মাধ্যমে বর্তমানে দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার ৭টি ইউনিয়ন পরিষদে অ্যাপসের মাধ্যমে দ্রæত সেবা প্রদান করছেন ইউপি চেয়ারম্যানগণ।
এই অ্যাপসের মাধ্যমে গ্রামবাসী তাদের ২৭টি অতি প্রয়োজনীয় সেবা যেমন,প্রত্যায়নপত্র বা সার্টিফিকেটের কাজ করে নিতে পারছেন ইউপি পরিষদ থেকে। এতে করে কারো কাছেই ধন্যা দিতে হচ্ছে না গ্রামবাসীদের। শুধু ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে আবেদন করলেই চেয়ারম্যান যে কোন স্থানেই থাক না কেন তিনি তার মোইবাই ডিভাইসে সংক্রিয়ভাবে ম্যাসেজ পেয়ে যাবেন এবং তিনি ওকে করলে মুহুর্তেই সেবা গ্রহীতা তারা কাঙ্খিত সেবাটি পেয়ে যাচ্ছেন।
উপজেলার ৫নং খয়েরবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে দেখা যায়, অগড়বাড়ী গ্রামের মো. জিল্লুর রহমান তার প্রয়োজনে আয়ের সনদের জন্য ইউনিয়ন পরিষদে এসেছেন। তারা পরিষদের বসেই আবেদন করার ১০ মিনিটের মধ্যে তার কাঙ্খিত সেবাটি পেয়ে গেলেন। এসময় তিনি বলেন,আগে এই কাজটি জন্য প্রথমে এলকার মেম্বারকে ধরতে হতো। তারপর ইউনিয়ন পরিষদে আসতে হতো। সার্টিফিকেট লেখা হলে আবার চেয়ারম্যানের স্বাক্ষরের জন্য অপেক্ষা করতে হতো। এতে করে কমপক্ষে দুএকদিন সময় লেগে যেতো; কিন্তু বর্তমানে এই সেবা মাত্র ১০মিনিটে পাওয়া গেল।
ব্যবহৃত অ্যাপস নিয়ে কথা হয় খয়েরবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. এনামুল হকের সাথে। তিনি বলেন, অ্যাপসিটি আমাদের উপহার দিয়েছেন সম্প্রতি বদলী হয়ে যাওয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রিয়াজ উদ্দিন সাহেব। অ্যাপস ব্যবহার বিষয়ে তিনি বলেন, এই অ্যাপস ব্যবহারের ফলে ইউনিয়নবাসীর বিভিন্ন সার্টিফিকেট প্রত্যায়নপত্র নেওয়া এখন সহজ হয়েছে। আমি যে কোন জায়গায় থাকিনা কেন? পরিষদ থেকে এলাকাবাসীর যে কোন সার্টিফিকেট প্রত্যায়নপত্রের প্রয়োজন হলে পরিষদে গিয়ে আবেদন করলে সংক্রিয়ভাবে আমার কাছে ম্যাসেজ চলে আসবে। আমি তা দেখে ওকে করলে, সেবা গ্রহীতা মুহুর্তেই সরকারি ফি এর টাকা জমা দিয়ে তার সেবা পেয়ে যাবে। একই কথা বলেন উপজেলার শিবনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সামেদুল ইসলামসহ অন্যান্য চেয়ারম্যানগণ।
এই অ্যাপসের মাধ্যমে কী কী সেবা পাওয়া যাবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ২৭টি অতি প্রয়োজনী সেবা পাওয়া যাবে এই অ্যাপসের মাধ্যমে। এর মধ্যে ট্রেড লাইসেন্স, উত্তরাধিকার সনদ, মৃত সনদ, জাতীয়তা সনদ, ভূমিহীন সনদ, নতুন ভোটরের প্রত্যায়ন, চারিত্রিক সনদ, একই ব্যক্তির সনদ, মুক্তিযোদ্ধা প্রত্যায়ন, বার্ষিক আয়ের সনদ, এতিম সনদ, বিবাহিত সনদ, মাসিক আয়ের সনদ, অবিবাহিত সনদ, পুণবিবাহের সনদ, বেকারত্বের সনদ, ট্যাক্স রেট ও বিবিধ, আর্থিক অস্বচ্ছলতার সনদ, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর প্রত্যায়ন, পরিবেশ ছাড়পত্র, ওয়ারিশান সনদ, কৃষক সনদ, মৎসজিবী সনদ, প্রতিবন্ধী সনদ, পশুর মালিকা সনদ, হিং¯্র প্রাণী কর্তৃক দংশনের প্রত্যায়ন প্রভৃতি প্রয়োজনীয় সেবা পাওয়া যাবে বা আমরা এলাকাবাসীকে এইসব সেবা দিচ্ছি। এই অ্যাপস ব্যবহারের ফলে মুঠোফোনে মুহুর্তেই দেখা সম্ভব হচ্ছে কোন সেবা থেকে কোত টাকা আয় করেছে ইউনিয়ন পরিষদ।
অ্যাপসটির উদ্ভাবক পরিকল্পনা, নির্মাণ ও জনগণের কাজে ব্যবহার্য করে তোলা ফুলবাড়ী উপজেলার সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রিয়াজ উদ্দিন (২১ ডিসেম্বর ২০২২) বদলী হয়ে বর্তমানে পঞ্চগড় জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক জানান, বাংলাদেশের কোথাও ইউনিয়ন পর্যায়ে এধরনের অ্যাপসের ব্যবহার নেই। এটি একদম ইউনিক। আমিই প্রথম ফুলবাড়ী উপজেলার ৭টি ইউনিয়নে ব্যবহার শুরু করেছি। এই অ্যাপসের মাধ্যমে এলাবাসী হয়রানী ছাড়াই দ্রæত ইউনিয়ন পরিষদ থেকে তাদের অতি প্রয়োজনীয় ২৭টি সেবা গ্রহণ করতে পারছেন। অ্যাপসটি ব্যবহারের মাধ্যমে ইউনিয়ন পরিষদগুলো কোন খাত থেকে কত আয় ব্যয় করছে তাও দেখা যাবে এবং অ্যাপসের কারণে সেবা গ্রহীতার সকল তথ্য আলাদা করে রেজিস্টারের লিপিবদ্ধ করার প্রয়োজন হবে না।
অ্যাপসের প্রয়োজনীয়তা সর্ম্পকে তিনি বলেন, আমি ফুলবাড়ীতে যোগদানের পর বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদ ভিজিটে গিয়ে তাদের ট্রেড লাইসেন্সের হিসেব আনতে বললে, সঠিক পরিসংখ্যান মিলতো না। ট্রেড লাইসেন্সের সরকারি ফি এর ৫০ শতাংশই ভ্যাট হিসেবে সরকারের কোষাগারে জমা করার নিয়ম থাকলেও তা পাওয়া কঠিন হতো। একই সাথে জনগনের বিভিন্ন সনদ প্রত্যায়ন পেতে নানা বিড়ম্বনার কথা ভেবে আমি একটি অ্যাপস তৈরীর কথা ভাবতে থাকি। পরবর্তীতে এই অ্যাপস তৈরি করে চালু করা হয়েছে এবং জনগণের সেবা দিচ্ছে। এই অ্যাপসের সাথে সংযুক্ত রয়েছে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি), উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার।
উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি), উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রারকে সংযুক্ত করার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সহকারী কমিশনার (ভূমি) এর দপ্তরে জমির খারিজ করতে এলে বিভিন্ন সময় ওয়ারিশান সার্টিফিকেটের প্রয়োজন হয়। তা মাঠ পর্যায়ে জানা কঠিন। কিন্তু এই অপ্যাসের মাধ্যমে সহকারী কমিশনার (ভূমি) অ্যাপসে প্রবেশ করে অনায়সে দেখতে পারবেন কোন ইউনিয়নের কাকে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ওয়ারিশান সার্টিফিকেট প্রদান করেছেন। একই ধরনের কারণে উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রারকে সংযুক্ত করা হয়েছে।
বর্তমান ফুলবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ ওয়াসিকুল ইসলাম বলেন, এটি একটি ভাল ব্যবস্থা। এই এ্যাপসের কারণে জনগণ সময় বাঁচিয়ে দ্রæত ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সেবাগুলো নিতে পারছে। এতে করে বলা যায় জনগণের ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সেবা সহজীকরণ হয়েছে এবং জনগণকে কোন সেবার জন্য বারবার ইউনিয়ন পরিষদের আসা যাওয়া করতে হচ্ছে না।