ফ্রিডম বাংলা নিউজ

বৃহস্পতিবার, মার্চ ২৮, ২০২৪ |

EN

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সুরক্ষায় ২১ শতকের তারুণ্য

ইয়াসির আরাফাত (তূর্য) | আপডেট: মঙ্গলবার, জানুয়ারী ১৭, ২০২৩

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সুরক্ষায় ২১ শতকের তারুণ্য
২৫ মার্চ রাতে গ্রেফতার হওয়ার কয়েক ঘন্টা পূর্বে আওয়ামীলীগের জাতীয় পর্যায়ের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দের উদ্দেশ্যে স্বাধীনতার মহান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অনুরোধ মাখা সুরে এই বলে আদেশ করেছিলেন যে, ‘আমি তোমাদের স্বাধীনতা দিয়েছি,এখন যাও, তাকে সংরক্ষণ করো।’(১)

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কোনো একদিন নিজ বাড়ির পাশে পায়ে চলা মেঠোপথে সদলবলে যাচ্ছেন এক তরুণ মুক্তিযোদ্ধা কমাণ্ডার। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য পাশ করা তরুণ প্রেমিকাকে বিয়ে করে গ্রামের বাড়ি ফিরেছেন সম্ভবত ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুর দিকে। সেদিন তিনি জানতেন না কি নির্মম নিষ্ঠুর আর সংগ্রামী দিনের বারতা নিয়ে জীবন সঙ্গিনীকে নিয়ে নিজ গৃহে ফিরেছেন। ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নিরস্ত্র ঘুমন্ত বাঙালি জাতিকে নির্বংশ করতে অপারেশন সার্চ লাইটের নামে গণহত্যা শুরু করলে জীবন সংশয়, সংসারের দোটানা; আর, মস্তিষ্কে জমে থাকা বিভ্রান্তির বাষ্প রগড়ে ঝেড়ে মুছে যুদ্ধে গিয়েছিলেন তিনি। নববধূ, মা, বাবা, ভাই, বোন কেউ আটকে রাখতে পারেনি বাংলা মায়ের সেই শ্রেষ্ঠ সাহসী স্বাধীনতাকামী আপোষহীন বীর দামাল সন্তানকে। পাক হানাদারদের প্রতিরোধে কোনো এক অপারেশন শেষে যেদিন সে তরুণ মুক্তিযোদ্ধা কমাণ্ডারের বেশে নিজ বাড়ির চৌহদ্দি পেরুচ্ছিলেন, তাঁর মা ছুটে এসে অনুনয় বিনয় করে একটু বসে যাওয়ার অপত্য স্নেহার্দ্র আকুতি জানিয়েছিলেন। হাত ধরে এমন কি গর্ভধারিনী মা হয়ে ছেলের পা জড়িয়ে ধরে অনুরোধ করে বলেছিলেন, ‘বাজান একটু পানি খায়া যা, বউডার লগে দুই চাইরডা কতা কয়া যা বাজান।’ তরুণ মুক্তিযোদ্ধা মায়ের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে পরিবারের অনিবার্য মায়ায় নিজের মন দুর্বল হওয়ার আশঙ্কায় আরোও দ্রুত বেগে পা চালিয়েছিলেন। ছয় মাস পর ১৬ ডিসেম্বর যেদিন তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে বাঙালি জাতির মহান বিজয়ের দিনে বিজয়ীর বেশে সদলবলে তরুণের নিজগৃহে ফিরে আসলে মায়ের বাঁধভাঙা আনন্দাশ্রু আর মুক্তিযোদ্ধাদের গগনবিদারী উচ্ছ্বাসে যে অমোঘ অনুভবের অনুরণন ঘটেছিল, তাই যে বাঙালি জাতির স্বাধীনতা অর্জনের দুর্লভ মুহূর্ত, সেদিনের শিশুরা তা বোঝা কিংবা উপলব্ধি করার কথা নয়। সে কথা তারা বড় হয়ে হয়তো বুঝেছে বা জীবনের আতিশয্য মোহমায়া ভুলে একটি জাতির স্বাধীনতার স্বরূপ কি তা বোঝার চেষ্টাই কখনো করেনি তারা! একটি জাতিগোষ্ঠীরর সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক স্বীকৃতির পূর্বে রাজনৈতিক আত্মপরিচয়, সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা কতটা প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ যুগের পর যুগ ধরে তা উপলব্ধি করছে ইসরাইলের সামগ্রিক হত্যাযজ্ঞ ও সামরিক আগ্রাসনের শিকার শত বছর ধরে স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত আরবের ফিলিস্তিনি মুসলমানগণ, মায়ানমারের সেনাবাহিনী কর্তৃক গণহত্যার শিকার জোরপূর্বক বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠী, হাজার বছর ধরে নিষ্পেষিত চীনের উইঘুর জাতিগোষ্ঠী, পাকিস্তানের স্বাধীনতাকামী বালুচ জাতিগোষ্ঠী ও ভারত পাকিস্তান উভয় রাষ্ট্রের অমানবিক দখলদারি ও আগ্রাসনের শিকার কাশ্মিরী জাতিগোষ্ঠী সহ বিশ্বব্যাপি নিপিড়িত বঞ্চিত, পরাধীনতার ক্লেদজ বিষে ভারাক্রান্ত কর্তৃত্ববাদীদের আগ্রাসনের শিকার ছোট বড় নৃতাত্ত্বিক সমাজ স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক ইতিহাস ঐতিহ্যের অধিকারী বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী। তবে সার্বিকভাবে বিজয়ের দৃশ্য বা উদযাপনের অনুভূতিজাত ব্যঞ্জনা সবার জন্য আনন্দময় ছিল না। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে যাওয়া অনেক মায়ের নাড়িছেঁড়া ধন একমাত্র সন্তান ফিরে আসেনি। অনেকের লাশও খুঁজে পাওয়া যায়নি। অনেককে নির্মম নির্যাতন শেষে হত্যা করে মৃতদেহকে ক্ষতবিক্ষত করে নর্দমায় গণচাপা দেয়া হয়েছে। স্বামী-সন্তানের প্রতীক্ষায় থেকেছেন লাখো বাঙালি নারী। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, যুদ্ধাপরাধী আলবদর, আল শামস ও রাজাকারদের নির্মম হত্যাযজ্ঞ, অবর্ণনীয় বর্বরতার শিকার হয়েছেন সব ধর্মের বাঙালি নারীরা, দেহমনে যন্ত্রণার দগদগে ক্ষত নিয়ে সমাজের কাছে ধিক্কৃত হয়েছেন। আর এসবই হয়েছিল এদেশ ও জাতির শত্রু কিছু মীরজাফর ক্ষমতালিপ্সু দালালদের প্রত্যক্ষ সহযোগীতায়। যাদের নিষ্ঠুরতা বর্বরতা হিটলারের নৃশংস 'গেস্টাপো' বাহিনীকেও হার মানিয়েছে। ব্রিটিশ বেনিয়ার তল্পিবাহক মীরজাফর, একাত্তরের রাজাকারদের এ যুগের উত্তরাধিকার দেশদ্রোহী ইসরালের কুখ্যাত গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সাথে আতাতকারী দুর্নীতির অভয়ারণ্য,গুজব সন্ত্রাস, আগুন সন্ত্রাস বিএনপি জামায়াত ও স্বাধীনতাবিরোধী রগকাটায় পারদর্শী শিবিরের আপডেট ভার্সন বিকাশ নুরু গং। আশার কথা অবশ্য বাংলাদেশবিরোধী শক্তির একতরফা বিরোধীতার স্বার্থে বিরোধীতা নির্ভর একঘেয়ে রাজনীতি ও বিদেশী প্রভুদের ঘুষ দিয়ে দেশবিরোধী কার্যক্রম বাস্তবায়নের নষ্ট আস্ফালন দেখতে দেখতে দেশ ও বিশ্ব রাজনীতি সম্পর্কে সচেতন শিক্ষিত জনগণ এখন প্রচণ্ড বিরক্ত। 

প্রসঙ্গক্রমে, আমার সাথে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন, কোন ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসের কোন এক বৃহস্পতিবার, শামসু ভাইয়ের ক্যান্টিন থেকে লাঞ্চ সেরে টিউশনে যাবার জন্য শাহবাগ মোড়ে দাড়িয়ে ছিলাম কাঙ্ক্ষিত বাসের আশায়। একজন ৮০ উর্ধ্ব বয়সের বীর মুক্তিযোদ্ধার বুকে মুক্তিযোদ্ধাদের লাল সাদা ব্যাজ দেখে সালাম জানালাম, সালামের উত্তর দিয়ে তিনি হাত বাড়িয়ে জয় বাংলা বলে নিজের নাম পরিচয় ও মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর নম্বর জানিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় করলেন। আমি ভদ্রলোককে দাদু বলে সম্বোধন করে নিজের পরিচয় প্রদান করে কিভাবে সাহায্য করতে পারি জানাতেই তিনি অশ্রুসিক্ত নয়নে একটি মাত্র অনুরোধ করলেন যেন কোনদিন এ দেশ মা ও মাটির সাথে বেইমানি না করি। আমি তাঁর কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়ার পরই অভূতপূর্ব স্মিত হাসি দিয়ে দোয়া করে চা খেতে অফার করতেই আমার কাঙ্ক্ষিত লোকাল বাস চলে আসায় বিদায় নিতে বাধ্য হলাম। 

প্রায় দেড় দশকে বাংলাদেশের অব্যাহত উন্নয়ন নির্ভর কন্টেম্পরারি রাজনীতিকে বিচার বিশ্লেষণ করে ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব গীতিকার, প্রখ্যাত লেখক ও প্রাবন্ধিক আব্দুল গাফফার চৌধুরী তাঁর বিভিন্ন লেখায় ধীর গতিতে উন্নয়নের পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁর যুক্তি ছিল দ্রুত গতিতে উন্নয়ন হলে সরকার বিরোধীপক্ষের চক্ষুশুলে পরিনত হবে আর বিদেশী কিছু মোড়ল রাষ্ট্র আমাদের সাফল্য মেনে নিতে পারবে না। গাফফার চৌধুরির কথা আজকের দিনে হুবহু মিলে যাচ্ছে! মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন কৌশলে নিজেদের এদেশীয় কৃতদাস পলাশী যুদ্ধপরবর্তী মীর জাফর আলী খান গোছের দালাল সরকার তৈরির জন্য লাগাতার তদবির করেছে এখন অবশ্য আপামর দেশপ্রেমিক জনগণের ঐক্যবদ্ধ দৃঢ়তার কাছে চুপসে গেছে বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের গড ফাদার মার্কিন কারসাজি । বাংলাদেশ নিয়ে এত খবরদারি করার অন্যতম কারণ একটি তৃতীয় সারির দেশের এমন অভূতপূর্ব গতিতে দুর্বার এগিয়ে যাওয়াকে তারা মেনে নিতে পারছে না। একাত্তরের পরাজিত প্রেতাত্মা আল বদর, আল শামস্, রাজাকার যুদ্ধাপরাধীদের আতুরঘর স্বাধীনতা বিরোধী বিএনপি জামায়াত আদা জল খেয়ে মাঠে নেমেছে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী, স্বাধীনতার ৫১ বছরের ইতিহাসে সফলতম সরকার শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন করতেই হবে! কারন তারাও বিদেশি শক্তির ন্যায় স্বাধীনতার মহান স্থপতি বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রক্ত ও আদর্শের উত্তরাধিকার প্রাণের নেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশের এমন অভূতপূর্ব সাফল্য মেনে নিতে পারছে না। তবে পিতা মুজিব, মা ও মাটির মহাকালের ইতিহাসের মহান সোপানে তাঁর তর্জনীর যে অবিনাশী দাপট বাঙালি জাতির কাছে আমানত হিসেবে রেখে গিয়েছেন, তাকে অক্ষুণ্ণ ও সমুন্নত রাখতে সারা বিশ্বের মুজিবসৈনিকদের সার্বিক কর্মসূচী গ্রহণ করতে হবে।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি, পাকিস্তানের বন্দিশালা থেকে মুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিন দৈনিক বাংলা পত্রিকায় সাক্ষাৎকারে স্বাধীন বাংলাদেশকে একটি সুখী সমৃদ্ধ সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য বাঙালি জাতির প্রতি নিষ্ঠা ও নিঃস্বার্থ ভাবে কাজ করে যাওয়ার আহ্বান জানান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এর আগেও স্বাধীনতার পর থেকেই একাধিকবার নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। লন্ডন ক্লিনিকে অস্ত্রোপচারের পর প্রথম গোলাম রসূল মল্লিকের সঙ্গে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা ও সুসংহত করার কাজ কঠিন বলে উল্লেখ করেন।

কাজেই, মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় স্নাত হয়ে মুজিব আদর্শকে সমুন্নত রেখে দেশদ্রোহী মুসলমানের শত্রু ইসরাইলের দালাল জামাত শিবির বিএনপি নুরু গং ও সর্বস্তরের দুর্নীতিবাজদের অস্তিত্বে চরম আঘাত হেনে বীর মুক্তিযোদ্ধা লাখো শহীদ ভাইয়ের বীরাঙ্গনা বাঙালির মায়ের এবং জাতির পিতার পবিত্র রক্তস্নাত এ পবিত্র ভূমি থেকে তাদের চিরতরে বিতাড়িত করতে হবে। আমাদের ভুলে গেলে চলবেনা যে বঙ্গবন্ধু বলে গিয়েছেন ‘‘কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না।’’

জয়বাংলা, জয়বঙ্গবন্ধু
বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।

ইয়াসির আরাফাত-তূর্য,
সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক,
বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

রেফারেন্সসমূহ : (১) Sheikh Mujib: Triumph and Tragedy by S.A.Karim.