শীত মৌসুমে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেজুরের রস এখন আর তেমন দেখা যায়না। গ্রামে কিছুটা থাকলেও শহরে নেই বললেই চলে। গাছ কমে যাওয়া ও আধুনিকতার চাপ সহ নানা কারণে এখন কেই চাইলেও খুব সহজে খেজুরের রসে তৈরী স্বাদের পিঠা-পুলির স্বাদ নিতে পারছেনা। আর এরই মধ্যে কক্সবাজার শহর থেকে মাত্র আড়াই কিলোমিটার দূরে খুরুশকুলের মনোপাড়ায় শখের বসে একজন গড়ে তুলেছেন খেজুর বাগান। যে বাগান থেকে দৈনিক ৮'শ থেকে ৯'শ লিটার খেজুরের রস উৎপান করা হয়। আর এই রস সিদ্ধ করে রাফ ও গুড় তৈরী করা হয়।
এদিকে জেঁকে বসা শীতে খেজুরের রস খেতে ওই বাগানে ভিড় করছে শহরের লোকজন ও পর্যটক। তারা খেজুরের রস খাওয়ার পাশাপাশি ঘুরে দেখছেন গ্রাম বাংলার খেজুর বাগান। আর গাছের নীচে বসেই স্বাদ নিচ্ছে খেজুর রসের। সাথে পার্সেল করে নিচ্ছে পরিবারের জন্য।
সরেজমিনে দেখা যায়, ভোর ৫ টা থেকেই শুরু হয় ওই বাগানের কর্মব্যস্থতা। ৬ টার আগেই গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে বিশেষ ধরণের বড়-বড় ট্রে থেকে সিদ্ধ করা শুরু হয়। এরই মধ্যে ভিড় জমতে থাকে লোকজনের। বিশেষ করে মোটরসাইকেল আরোহী তরুনরা ভিড় জমায়। এই ভিড়ে অনেক পর্যটকদেরও দেখা যাচ্ছে। যেখানে প্রায় দুই' শতাধিক লোকজনের ভিড় হয়। তারা ওখানে দাঁড়িয়েই গরম খেজুরের রস খায়। অনেকে সিদ্ধ হওয়ার আগে'ই কাঁচা খেয়ে ফেলে। বেশিরভাগ'ই খাওয়া শেষে প্লাস্টি বোতলে করে নিয়ে যায়। অনেকে রসের পাশাপাশি খেজুরের রাফ ও গুড কিনে নেয়। এসব ছাড়াও ওখানে আসা লোকজন পুরো বাগার ঘুরে বেড়ায়। ছবি তোলা আর আড্ডা দেয় সময় কাটায়। এই ভিড় ভোর ৬ টা থেকে ৯ টার মধ্যে শেষ হয়ে যায়।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, শহরের কস্তুুরাঘাট এলাকার বাসিন্দা ছালেহ আহম্মদ শখের বসে খুরুশকুলের মনোপাড়ার এই খেজুর বাগান গড়ে তুলেন। ভ্রমণ প্রিয় এই মানুষ বিভিন্ন দেশ থেকে বিচ সংগ্রহ করে ১৯৯৫ সালের দিকে ৪৭ একর জায়গার মাছের ঘের সহ এই নারিকেল ও খেজুর বাগান করেন। গত ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করা হচ্ছে। যেখানে প্রায় ৫'শতাধিক খেজুর গাছ রয়েছে। ওই বাগানে ১০-১২ জন্য অভিজ্ঞ কারিগর কাজ করেন। যারা গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে। ওই রস সেদ্ধ করে ঘনত্ব বাড়িয়ে রাফ করা হয়। এরপর তা আরো সিদ্ধ করে বিভিন্ন ছাঁচে ঢেলে গুড় তৈরি কারা হয়।
ওই বাগানে খেজুরের রস খেতে আসা যুবক আরিফুল ইসলাম জানান, বন্ধুরা মিলে মোটরসাইকেল যোগে খেজুর বাগানে রস খেতে এসেছে। পাশাপাশি শহরের পাশেই গ্রাম্য পরিবেশে খেজুর বাগান ভ্রমণ করছে। ওই মুহুর্তটা খুবই আনন্দের।
স্বামীর সাথে কক্সবাজার বেড়াতে আসা পর্যটক নারী রুবিনা আক্তার জনান, কক্সবাজার বেড়াতে আসার একদিন পরেই জানতে পারেন এই খেজুর বাগান সর্ম্পকে। সত্যিই এই বাগান খুবই সুন্দর। ভোরে কোয়াশার মাঝে গাছের নীচে বসে খেজুরের রস খাওয়ার মজাটাই আলাদা।
স্থানীয় মোরব্বী লিয়াকত মিলা জানান, এই বাগানের মালিক ছালেহ আহম্মদ একজন প্রকৃতি প্রেমী মানুষ। তার কারণে আজকে শহরের লোকজন বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম দেখতে পাচ্ছে এই খেজুর বাগান। এছাড়া তারা স্বাদ নিতে পারছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেজুরের রস। পাশাপাশি এটি ভ্রমণ পিপাসোদের পছন্দের জায়গায় পরিণত হচ্ছে।
বাগানের কর্মী ফরিদ হোসেন পান্না জানান, শীতের সময় অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত খেজুরের রস সংগহ করা হয়। শীত যত বেশি পড়বে, খেজুরের রস তত বেশি মিষ্টি হবে। সেই রসে গুড়ও ভালো হয়। শীত চলে গেলে এই রস টক হয়ে যায়। খেজুরের গাছ পরিচর্যা থেকে শুরু করে গুরু সংগ্রহ পর্যন্ত অত্যন্ত দক্ষতার সাথে কাজ করতে হয়।
খেজুর বাগানের আরেক কারিগর মান্নান জানান, রস সংগ্রহের জন্য বিশেষ কৌশলে গাছ কাটতে হয়। প্রাথমিক অবস্থায় রস পাতলা থাকে। পরে সেদ্ধ করে ঘনত্ব বাড়ানো হয়। ঘনত্ব নির্দিষ্ট পরিমাণে পৌঁছালে রস লালচে বর্ণ ধারণ করে 'রাফে' পরিণত হয়। এরপর সিদ্ধ করে গুড় তৈরির উপযোগী করে রস বিভিন্ন ছাঁচে ঢালা হয়। পরে সেই রস ঠান্ডা হয়ে সুস্বাদু গুড়ে পরিণত হয়।
বাগাল মালিক ছালেহ আহম্মদের ছেলে সাইমন ছালেহ জানান, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি পরিবেশের কথা ভেবে এই বাগান থেকে বানিজ্যিকভাবে রস আহরণ করা হলেও তাদের মূল উদ্দেশ্য বাংলার ঐতিহ্য ধরে রাখা।