ভেঙে ফেলা হচ্ছে খুলনার বহুল আলোচিত এরশাদ শিকদারের সেই প্রাসাদোপম বাড়ি 'স্বর্ণকমল'। আজ বৃহস্পতিবার সকালে খুলনা নগরীর সোনাডাঙ্গা এলাকার ১৩৫ নম্বর মজিদ সরণির স্বর্ণকমল বাড়ির সামনে গিয়ে দেখা যায় উৎসুক মানুষের ভিড়।
অনেকেই কৌতুহলবশত দাঁড়িয়ে বাড়িটি ভাঙার কার্যক্রম দেখছেন। কেন, কী কারণে বাড়ি ভাঙা হচ্ছে, তা নিয়ে আলোচনা করছেন।
দেখা গেছে, বাড়ির মূল গেট ভেতর থেকে তালা দেওয়া। দোতলা বাড়ির ছাদে বড় হাতুড়ি ও ড্রিল মেশিনসহ যন্ত্রপাতি দিয়ে ভবন ভাঙার কাজ করছেন ১০-১২ জন শ্রমিক। দোতলার মূল ভবনের সামনে ছোট্ট যে পুরোনো ৩তলা ভবন ছিল, সেটি আগেই পুরোপুরি ভাঙা হয়ে গেছে। সেখানে পড়ে আছে ইটসহ ভাঙা ভবনের কিছু অংশ।
বহু মানুষকে হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধে ২০০৪ সালের ১০ মে খুলনা কারাগারে ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয় এরশাদ শিকদারের। তার আগে কয়েক বছর ধরে একে একে বেরিয়ে আসতে থাকে তার হত্যা আর নির্যাতনের সব রোমহর্ষক কাহিনী। বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোচিত একজন ব্যক্তিতে পরিণত হন এরশাদ শিকদার। আর খুলনা শহরে তার প্রাসাদোপম বাড়িটি পরিণত হয় মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রস্থলে।
আজও বহু মানুষ খুলনা গেলে শহরের অভিজাতক এলাকা সোনাডাঙ্গা রোডের এই বাড়িটির সামনে একবার ঢুঁ মারতে ভোলেন না।
খুলনা নগরীর ১৩৫ নম্বর মজিদ সরণি এলাকায় এরশাদ শিকদার গড়ে তোলেন তার বিশাসবহুল স্বর্ণকমল। সুড়ঙ্গপথ, গোপন বৈঠকখানা, অস্ত্র ও অর্থসম্পদ রাখার সব ব্যবস্থার পাশাপাশি নান্দনিকতার ছোঁয়ায় ভরপুর ছিল ভবনটি।
সেই স্বর্ণকমল এখন ভেঙে ফেলা হচ্ছে। তবে পারিবারিকভাবে জানা গেছে, দোতলা বাড়ির পুরোটা নয়, ভাঙা হচ্ছে অর্ধেকের মতো অংশ। ইতোমধ্যে পুরোনো ছোট্ট ৩ তলা বাড়ির পুরোটাই ভেঙে ফেলা হয়েছে। ভেঙে ফেলা বাড়ির স্থানে নতুন করে ১০তলা বাড়ি নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে এরশাদ শিকদারের সন্তানদের।
এরশাদ শিকদারের মেজো ছেলে কামাল শিকদার জানান, মজিদ সরণিতে খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (কেডিএ) ১০ কাঠা জমির ওপর তাদের একটি পুরোনো ৩তলা এবং আরেকটি দোতলা বাড়ি ছিল। দোতলা ভবনটির নামই মূলত 'স্বর্ণকমল'। কয়েকদিন আগে তারা পুরোনো ৩তলা ভবনটি শ্রমিক দিয়ে ভেঙে ফেলেছেন। এখন দোতলা ভবনটির অর্ধেকের মতো অংশ ভাঙা হচ্ছে।
জানা গেছে, ১০ কাঠা জমির মধ্যে ৫ কাঠা জমি তার বাবা এরশাদ শিকদারের নামে এবং বাকি ৫ কাঠা তার মা খোদেজা বেগমের নামে। তার মায়ের নামে যে অংশ মূলত সেই অংশের স্থাপনা অপসারণ করা হচ্ছে। ওই ৫ কাঠা জমির ওপর ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ১০তলা ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে।
কামাল শিকদার বলেন, 'আমরা মূলত মায়ের অংশে ডেভলপারদের দিয়ে ফিফটি ফিফটি শেয়ারে ১০তলা ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা করছি, ঢাকার দুটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ইতোমধ্য কথা হয়েছে।'
'আসলে বাবার নামে যে অংশ আছে আমরা তা বিক্রি করব না, বাবা স্মৃতি হিসেবে থাকবেন', বলেন তিনি।
বর্তমান ওই বাড়িতে বসবাস করছেন এরশাদ শিকদারের প্রথম স্ত্রী, তার শাশুড়ি, ৩ ছেলে ও তাদের ৬ সন্তান। প্রথম পক্ষের মেয়ে থাকেন শ্বশুরবাড়িতে। আর দ্বিতীয় স্ত্রী সনজীদা নাহার শোভা থাকেন অন্য জায়গায়।
১৯৮২ সালে এইচ এম এরশাদের সামরিক সরকার ক্ষমতায় আসার পর ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠেন খুলনার এরশাদ শিকদার। তার উত্থান হয়েছিল খুলনা ডকইয়ার্ডের একজন সাধারণ কুলি হিসেবে। পরে সেখানে তিনি ঘাট সর্দার বা কুলিদের সর্দার হয়ে উঠেন।
তার বিরুদ্ধে অন্তত ২৪ জনকে হত্যার অভিযোগ ছিল। অনেককেই তিনি হত্যা করে মরদেহ গুম করে ফেলতেন। ফলে মরদেহ পাওয়া যেত না, কোনো মামলাও হতো না।
এরশাদ সরকারের পর বিএনপি, এরপর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলেও এরশাদ শিকদারের ক্ষমতায় ভাটা পড়েনি। কিন্তু ১৯৯৯ সালে তার বিরুদ্ধে খুলনার একজন যুবলীগ নেতাকে হত্যার অভিযোগ ওঠার পর পাশার দান উল্টে যায়। তার বিরুদ্ধে রাজস্বাক্ষী হয় তার নিজের দেহরক্ষী। সেই হত্যার অপরাধে তার মৃত্যুদণ্ড হয়।
এরশাদ শিকদারের জন্ম ঝালকাঠির নলছিটিতে, ১৯৬৭ সালে তিনি খুলনায় চলে যান। সেখানে রেলস্টেশনে কুলির কাজের পাশাপাশি রেললাইনের পাত চুরি করে বিক্রি করতেন। এই কারণেই তিনি 'রাঙ্গা চোর' হিসেবে পরিচিতি পান।
খুলনা রেল স্টেশন, ৪ ও ৫ নম্বর ঘাট এলাকায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শুরু করেন আর সেই সময় তিনি গঠন করেন একটি সন্ত্রাসী বাহিনী।
এরশাদের শাসনামলে রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ফলে বরফকল, শহরে স্বর্ণকমল নামের প্রাসাদোপম বাড়িসহ বিপুল সম্পত্তির মালিক হয়ে ওঠে এরশাদ শিকার। এরপর তিনি জড়িয়ে পড়েন রেলওয়ের সম্পত্তি দখল, ব্যক্তিগত সম্পত্তি দখল, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, হত্যাকাণ্ডের অসংখ্য অপরাধে।
১৯৮৮ সালে খুলনার ২১ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনারও নির্বাচিত হন এরশাদ শিকদার। ফাঁসিতে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ওই ওয়ার্ডের কমিশনার ছিলেন তিনি। কিন্তু কমিশনার হওয়ার পর তার অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থামেনি।
এরশাদ শিকদারের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও দেহরক্ষী নূরে আলম তার বিরুদ্ধে আদালতে যে সাক্ষ্য দিয়েছেন, সেখানে উল্লেখ করেছিলেন যে, এরশাদ শিকদারের ২৪টি হত্যাকাণ্ড তিনি দেখেছেন। এর বাইরে সব মিলিয়ে ৬০টি হত্যাকাণ্ড করেছেন বলে তিনি জানতে পেরেছেন।
২০০০ সালের ৩০ এপ্রিল এরশাদ শিকদারের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করেন খুলনার আদালত। তবে আপিল এবং রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষার পর্ব পার হয়ে সেই ফাঁসি কার্যকর হয় ২০০৪ সালের ১০ মে।