দিনাজপুর বিরামপুর নামের উৎপত্তি সম্পর্কে একটি মুখরোচক গল্প শোনা যায়। চরকাই রেলস্টেশন থেকে প্রায় এক কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে একটি ঢিপি আছে । লোকে এ ঢিপিকে বলে চোর চক্রবর্তীর ঢিপি।
লোক মুখে শোনা যায়, প্রাচীনকালে সেখানে এক ধনাঢ্য ব্রাহ্মণ বাস করতেন। তার একমাত্র পুত্র বাল্যকালেই নাকি চৌর্যবিদ্যায় অত্যন্ত পারদর্শী হয়ে ওঠে। বালকের পিতা চৌর্যবৃত্তি থেকে নিবৃত্ত করার জন্য একটি কৌশল অবলম্বন করেন। তিনি একটি থালাতে কিছু টাকা রেখে টাকাগুলি ছাই দিয়ে ঢেকে দেন। তারপর তিনি বালককে আদেশ দেন, ছাইগুলি ফুঁ দিয়ে সরিয়ে টাকাগুলি নিয়ে যেতে।
কিন্তু শর্ত থাকে যে, ফুঁ দিয়ে ছাই সরাবার সময় যদি একটা ছাই মুখে লাগে তবে বালককে জীবনের জন্য চৌর্যবৃত্তি ছেড়ে দিতে হবে। বালক হাসিমুখে শর্ত মেনে নিয়ে পরীক্ষা দিতে প্রস্তুত হয়। সে এক খন্ড লম্বা বাঁশের চোঙ্গা জোগাড় করে, চোঙ্গার ভিতর দিয়ে ফুঁ দিয়ে সরিয়ে ফেলে এবং তাতে একটা ছাইও তার মুখে লাগেনি। অতঃপর মনের খুশিতে সে টাকাগুলি তুলে নেয়।
অতি অল্প বয়সে বালকের এহেন চতুরতা দেখে বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দেন। বালক চৌর্যবিদ্যায় হাত পাকাতে থাকে। বড় হয়ে সে নিজ দেশ ছাড়াও অঙ্গ, কলিঙ্গ, মগধ, মিথিলা, ত্রিহুত, পাটলিপুত্র, অবন্তী, মৎস্য, কান্যকুব্জ প্রভৃতি দেশে অতি নিপুণতার সাথে চৌর্যবৃত্তি করতে থাকে এবং অশেষ ধনরত্নের অধিকারী হয়ে সে এখানে প্রাসাদসম এক বিরাট অট্টালিকা নির্মাণ করে। জনশ্রুতি আছে যে, তার অট্টালিকা আশপাশ এলাকা জুড়ে ছোট নদী বেষ্টিত ছিল এবং নদীতে সোনার নৌকায় সে যাতায়াত করতো।
একবার মগধ দেশের পূর্ব প্রান্তে চুরি করতে গিয়ে সে প্রায় ধরা পড়ে যায়। প্রাণভয়ে অশ্বারোহণে অতি দ্রুতগতিতে গৃহাভিমুখে প্রত্যাবর্তন করতে থাকলে মগধরাজের সৈন্যরাও তার পিছে পিছে ধাওয়া করেন। ছুটতে ছুটতে সে তার প্রসাদে এসে প্রবেশ করলে পশ্চাদ্ধাবনকারীরা তার প্রাসাদের সামনে এসে তাজ্জব হয়ে বলেন, 'এটাতো রাজ প্রাসাদ, চোর কই?' এবং 'চোরকই' 'চোরকই' বলে তারা চেঁচাতে থাকেন। সেই থেকেই নাকি এ স্থানের নাম হয় চরকাই (<চরকই<চোরকই)। এই চোর চক্রবর্তী নাম সম্পর্কে বলা যেতে পারে যে, ইমারতটি বহুকাল আগে পরিত্যক্ত হবার পরে কোনো এক সময়ে হয়তো।
এখানে চোর-ডাকাতের আড্ডা গড়ে ওঠে। তাদের মধ্যে কোন একজন হয়তো নিজ ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে অসামান্য কৃতিত্বের জন্য 'চোর চক্রবর্তী' (অর্থাৎ চোরদের শিরোমণি) আখ্যা লাভ করে। সেই স্বনামধন্য 'চোর চক্রবর্তী' মশায়ের নামের সঙ্গে জড়িত হয়ে এ স্থানের চোর চক্রবর্তী নামকরণ হয়ে থাকতে পারে এবং পরে এ স্থান বোধহয় এ নামেই পরিচিত হয়ে ওঠে। এ চোর চক্রবর্তী থেকেই চরকাই নামের উদ্ভব বলে ধারণা করা যায়। এ অঞ্চলে এটি একটি প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ দুর্গ। মাটির ঢিবিটি বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের এর তালিকাভুক্ত একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা।
১৯৬৮ সালে উৎখননের কাজ শুরু হয়। বাংলাদেশ সরকারের জাদুঘর ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। ১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ শাসনামলে সেই চরকাই নামে রেলস্টেশন নির্মাণ হলে ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে ২৩ জুন চরকাই নাম পরিবর্তন করে বিরামপুর রেলস্টেশন নামকরণ করা হয়।
আর একটি জনশ্রুতি আছে,মোঘল সম্রাট আকবর বৈরামখানের অভিভাবকত্বে ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দে পানিপথের ২য় যুদ্ধে জয়লাভ করে দিল্লীর অধিপতি হন। বালেগ হয়ে বৈরামখানের অভিভাবকত্ব ছিন্ন করে মহামতি আকবর ১৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দে কররানীকে পরাভুত করে বাংলা জয় করেন।
কথিত আছে, আকবরের সময় বাংলার বারো ভুঁইয়াদের মধ্যে পাতরদাস নামক এক শক্তিশালী রাজা ছিলেন। তার রাজধানী ছিল এই এলাকায়। রাজা পাতরদাস মোগল সেনাপতি বৈরাম খাঁর নিকট যুদ্ধে পরাজয় বরণ করেন। সেনাপতি বৈরাম খাঁর নামে এই এলাকার নাম হয় বিরামপুর।
আরেক ভাষ্যমতে, সম্রাট আকবর বিষ্ণুদত্তকে কান্নগো রুপে দিনাজপুরের রাজস্ব নির্ধারণ ও আদায়ের বন্দোবস্তের জন্য প্রেরণ করেন। বিষ্ণুদত্ত বৈরামখানের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন। অনেক ঐতিহাসিকের মতে এ ভক্ত বিষ্ণুদত্তই বৈরামখানের নামানুসারে ভোলাগঞ্জ নাম পরিবর্তন করে এ স্থানের নাম রাখেন বিরামপুর।