কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলায় গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর),কাজের বিনিময়ে টাকা (কাবিটা) ও কাজের বিনিময় খাদ্য (কাবিখা) কর্মসূচির অধীনে বাস্তবায়িত প্রকল্পে কাজ নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। 'নাম আছে কাজ নেই' ধরণের এসব প্রকল্পের বেশিরভাগ কাজ বাস্তবায়ন না করেই টাকা উত্তোলন করে আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে।স্থানীয়দের অভিযোগ, স্থানীয় সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান ও প্রকল্প বাস্তাবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও)সহ সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধিদের যোগসাজসে সরকারি এসব প্রকল্পের টাকা বাটোয়ারা করে আত্মসাত করা হয়েছে।
উলিপুর উপজেলা প্রকল্প বাস্তাবায়ন কর্মকর্তার অফিস সূত্রে জানা যায়, উলিপুর উপজেলায় ২০২১- ২০২২ অর্থ-বছরে টিআর এর ১৯০টি প্রকল্পে ৩ কোটি ৬ লক্ষ ৭৬ হাজার ২১৮ টাকা, কাবিটার ৩৩টি প্রকল্পে ১ কোটি ৩৭ লক্ষ ৯৯ হাজার ১৬৮ টাকা এবং কাবিখার ৩৪টি প্রকল্পে ৩৬০ দশমিক ৯৮৯৫ মে.টন চাল এবং ২৫টি প্রকল্পে ২৯১ দশমিক ৯৮৫৭ মে.টন গম বরাদ্দ দেয় সরকার। এসব বরাদ্দে কুড়িগ্রাম-৩ আসনের সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান, সংশ্লিষ্ট পৌরসভার মেয়র, কাউন্সিলর, ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ও সদস্যদের সঙ্গে সমন্বয় করে প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হয়। কাজের তদারকি করেন সংশ্লিষ্ট উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও)। তবে স্থানীয়দের অভিযোগ, উপজেলায় বেশিরভাগ প্রকল্পের কাজ হয়নি, আবার চোখে ধূলো দেওয়ার উদ্দেশে কোথাও কোথাও নামমাত্র কাজ করে টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। তদারককারী ও বাস্তবায়নকারীদের ভাগবাটোয়ারার ফলে প্রকল্পের বাস্তবায়ন না করেই সিংহভাগ অর্থ চলে গেছে সংশ্লিষ্টদের পকেটে। নিরপেক্ষ তদন্তে এসবের সত্যতা বেরিয়ে আসবে বলে মনে করছেন প্রকল্প এলাকার বাসিন্দারা।
সরেজমিন কয়েকটি প্রকল্প এলাকা ঘুরে স্থানীয়দের অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। হাতিয়া ইউনিয়নের দিঘল হাইল্যা হিন্দুপাড়া থেকে চৌধুরীকুঠি পর্যন্ত রাস্তা সংস্কারের জন্য ১ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেখানো হলেও সরেজমিনে এই রাস্তার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। দিঘলহাইল্যা হিন্দুপাড়ার বাসিন্দা নীরদ দাস জানান, তাদের গ্রাম থেকে চৌধুরীকুঠি যাওয়ার কোন রাস্তাই নেই, তাই সংস্কারের প্রশ্নই আসে না। তাছাড়া কাদেরের বাড়ি থেকে মাঝিপাড়া পর্যন্ত রাস্তা গত ১০ বছরেও কেউ এক কোদাল মাটি ফেলেনি বলে দাবি করেন স্থানীয় আফসার আলি, আজিজুল হক।
তবকপুর ইউনিয়নের সাদুল্যা চাচিয়ারপাড় ইফসুফ আলী নুরানী মাদরাসায় মাটি ভরাটের জন্য কাবিটা প্রকল্পে ৪ লাখ টাকা বরাদ্দ হলেও প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক সামছুল হক বলেন,'তারা ওই প্রকল্পের কোনও টাকাই পাননি। মাদ্রাসায় মাটি ভরাটের কোনও কাজও হয়নি।'
উপজেলার বুড়াবুড়ি ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ডের ইসলাম বাজার হতে সরকার বাজার পর্যন্ত রাস্তা সংস্কারের জন্য কাবিটা প্রকল্পের ৪ লাখ টাকা, ৩ নং ওয়ার্ডে টিআর প্রকল্পের আওতায় ফকির মোহাম্মদ করবস্থানের মাঠি ভরাটের জন্য ৩ লাখ টাকা, ফকির মোহাম্মদ মন্ডলপাড়া জামে মসজিদের মাঠ ভরাটের জন্য ৩ লাখ টাকা, কামারপাড়া ওয়াক্তি মসজিদ সংস্কারের জন্য ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হলেও এসব বরাদ্দের কোনও হদিস পাননি সংশ্লিষ্ট মসজিদ-মাদ্রাসা কমিটির সভাপতিসহ সংশ্লিষ্টরা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব প্রকল্পে কোনও কাজও হয়নি। অথচ কাগজ কলমে কাজ সমাপ্ত দেখিয়ে গত জুনের মধ্যেই টাকা উত্তোলন দেখিয়েছেন পিআইও সিরাজুদ্দৌলা।
বুড়াবুড়ি ইউনিয়নের ফকির মোহাম্মদ কবরস্থান কমিটির সভাপতি হযরত আলী বলেন, 'আমি এ বিষয়ে কিছুই জানি না। কবরস্থানের মাটি ভরাটের জন্য আমরা কোন বরাদ্দ পাইনি। কোনও কাজ বাস্তবাযনও হয়নি। উপজেলার অন্যান্য ইউনিয়নেও এসব প্রকল্পের কোনও বাস্তবায়ন হয়নি বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দা ও জনপ্রতিনিধিরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও সদস্যরা বলেন, Ôবরাদ্দের অংশ স্থানীয় এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান ও পিআইওকে দেওয়ার পর সামান্য কাজ করা ছাড়া আর উপায় থাকে না। বাটোয়ারার পর আর কাজের কোনও টাকাই অবশিষ্ট থাকে না। ভাগ না বনায় গত বছর কিছু প্রকল্পের টাকা ফেরতও গেছে।'
উলিপুর উপজেলা পিআইও সিরাজুদ্দৌলা বলেন, কুড়িগ্রাম জেলা বন্যা প্রবণ এলাকা হওয়ায় জুন-জুলাই মাসের দিকে রাস্তা সংস্কার বা মাঠ ভরাটের কোনও মাটি পাওয়া যায়না। এজন্য অধিকাংশ কাজ শেষ করতে পারিনি। জুন মাসে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়, তাই প্রতিটি প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন দেখিয়ে চেক ইস্যু করে টাকা তুলে রাখা রাখা হয়েছে। এখন শুষ্ক মৌসুমে কাজ শুরু হয়েছে, যে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে সেই প্রকল্পের টাকা প্রদান করা হবে| তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কাজ বাস্তবায়ন না করে এভাবে টাকা তুলে রাখার কোনও সুযোগ নেই।'
উপজেলা চেয়ারম্যান গোলাম হোসেন মন্টুর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার নাম্বার বন্ধ পাওয়া গেছে।
কুড়িগ্রাম-৩ আসনের সংসদ সদস্য এম এ মতিন বলেন, এই কাজগুলো সাধারণত সংশ্লিষ্ট মসজিদ কমিটি, কবরস্থান কমিটি এবং রাস্তার কাজ হলে আমাদের দলের লোকজন করে থাকেন। সুপারভাইজার হিসাবে পিআইও থাকেন। আমি শুধু কাজের বরাদ্দ দিয়ে থাকি। তবে অভিযোগ পেলে আমি তদন্ত করে দেখবো।'