ফ্রিডম বাংলা নিউজ

সোমবার, জুলাই ৮, ২০২৪ |

EN

ভিটেমাটি-চাকরি হারিয়ে আবুল কালামের মানবেতর জীবন যাপন

মেহেদী হাসান, ফুলবাড়ী, দিনাজপুর | আপডেট: মঙ্গলবার, ডিসেম্বর ১৩, ২০২২

ভিটেমাটি-চাকরি হারিয়ে আবুল কালামের মানবেতর জীবন যাপন
বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির কারণে বাপ-দাদার ভিটেমাটি গেল,আন্দেলন করতে গিয়ে জেল খাটতে হলো। একমাত্র সম্বল ছিল খনিতে শ্রমিকের কাজ; করোনার কারণে সেই চাকরি হারিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে হচ্ছে এখন ভ্যান চালিয়ে।

 কথা গুলো আক্ষেপ করে বলছিলেন দেশের একমাত্র উৎপাদনশীল দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া কয়লা খনিতে কর্মরত একসময়ের ভুগর্ভস্থ শ্রমিক আবুল কালাম (৩৮)। বর্তামানে তিনি রিক্সা-ভ্যান চালক।

আবুল কালামের বাড়ী ছিল খনি সংলগ্ন জিগাগাড়ী গ্রামে। যা এখন বিরান ভূমি, ভূমি অবনমন (দেবে গিয়ে) জলমগ্ন হয়েগেছে। তার বাড়ীর ভিটে সহ ২০ শতক জমির জন্য ক্ষতিপূরনের মাত্র ৮ লাখ টাকা পেলেও নিজের পৈত্রিক জয়গা ছেড়ে অন্যত্র জায়গা কিনে বাড়ী করতে খরচ হয়েছে ১০ লাখ টাকা। এতে বাড়তি ঋণের বোঁঝা চেপেছে তার  মাথায়। ছিল একমাত্র সম্বল কয়লা খনির চাকুরী। তাও হারাতে হয়েছে দুই বছর পূর্বে করোনার কারণেই।

আবুল কালাম বলেন, দেশে করোনা মহামারির ভয়াবহতা কমে সবকিছু স্বাভাবিক হলেও; করোনার কথা বলে, কোয়ারেনটাইনের বাহানায় বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির ৫৪৫ জন শ্রমিক আজ আমরা বেকার হয়ে পড়েছি। এতে করে শ্রমিকরা তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে মানবতার জীবন যাপন করছেন।

জানা গেছে, দেশে প্রথম করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির কথা জানা যায় ২০২০ সালের ৮ মার্চ এবং প্রথম মৃত্যু ঘটে ২০ মার্চ। এরপর ১৭ মার্চ সরকার প্রথম সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেন। এপ্রিল মাসে সারা দেশে লকডাউন ঘোষনা করা হয়। ওই সময় ২৬ মার্চ কয়লাখনি ছুটি ঘোষনা করে কতৃপক্ষ । এসময় খনির সকল দেশী শ্রমিকদের ছুটি দিয়ে বের করে দেয়া হয়। সেই সময় শ্রমিকদের ৪ হাজার টাকা ভাতা এবং দেড় হাজার টাকা রেশন বরাদ্দ করা হয়। কিন্তু অনেকেই শুধুমাত্র রেশন বাবদ দেড় হাজার টাকা পেলেও ভাতার ৪ হাজার টাকা কেউ কেউ পায়নি এমন অভিযোগ শ্রমিকদের।

পরে খনি সচল করতে ১হাজার ৪৫ জন শ্রমিকের মধ্যে পর্যায় ক্রমে ৫ শত শ্রমিককে কাজে নেওয়া হলেও বাকী শ্রমিকরা বেকার হয়ে পড়ে। এরপর চলতি বছরের এপ্রিল মাসে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিএমসি-এক্সএমসি কনসোর্টিয়ামের অধীনে কর্মরত দেশি শ্রমিকদের স্ব-স্ব কর্মস্থলে যোগদানসহ করোনাকালীন বকেয়া বেতন-ভাতার দাবিতে টানা এক মাসব্যাপী পরিবার-পরিজন নিয়ে আন্দোলন করেন শ্রমিকরা। দফায় দফায় আলোচনা শেষে খনি কর্তৃপক্ষ পর্যায়ক্রমে ওইসব শ্রমিকদের কাজে যোগদানের আশ্বাস প্রদান করলেও ঘুরেফিরে ৫ শত শ্রমিক কাজ করছে,বাকীরা কাজে যোগদান করতে পারেননি আজও।

খনি শ্রমিক মো. রহিম উদ্দিনসহ অন্যান্য বেকার শ্রমিকরা জানান, করোনা পরবর্তী সময়ে সকল সরকারি-বেসরকারি ও স্বায়ত্ব শাসিত প্রতিষ্ঠান পূর্বের মতোই চালু হলেও অজ্ঞাত কারণে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনিতে তাদের স্ব-স্ব কর্মস্থলে খনি কর্তৃপক্ষ যোগদানের কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করছেননা। যারা ভিতরে কাজ করছেন তাদের বাইরেও আসতে দিচ্ছেন না। অথচ কর্মকতাদের ক্ষেত্রে এই নিয়ম নেই।

বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি মো. জাকির হোসেন জানান, খনির শুরু থেকে আমরা কাজ করে আসছি। প্রায় ২ যুগ ধরে চীনা ঠিকাদরী প্রতিষ্ঠান দেশী শ্রমিকদেরকে জিম্মি করে কাজ করাচ্ছেন। তারা শ্রমিকদের কোন দাবি দাওয়া মানছেন না। আন্দোলন করতে গেলে চীনা কোম্পানি ও খনি কর্তৃপক্ষ উল্টো শ্রমিকদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে তাদের হয়রানী করছেন। এসব শ্রমিকরা দীর্ঘদিন থেকে আন্দোলন সংগ্রাম করলেও তাদের কাজে যোগদানের বিষয়ে কোন সঠিক সিদ্ধান্ত কিংবা সমস্যার সমাধান হয়নি আজও।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে মতে, দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি থেকে উৎপাদিত কয়লা দিয়ে বড়পুকুরিয়া কয়লা ভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। যা জাতীয় গ্রিডে সংযোগ করা হয়।

এদিকে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) মো. জাফর সাদিক জানান, বর্তমানে খনিতে ৬৮০ জন দেশী শ্রমিক কয়লা উত্তোলনের কাজ করছেন। এই কয়লা বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে ব্যবহার করা হয়। ২২ নভেম্বর খনি থেকে রেকর্ড পরিমাণ কয়লা উত্তোলন হয়, যার পরিমাণ সাড়ে ৫ হাজার মেট্রিকটনের উর্দ্ধে। ফলে এই শ্রমিক দিয়ে কয়লা উত্তোলন ও উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার কোন আশংকা নেই।

শ্রমিক নিয়োগের বিষয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, পর্যায় ক্রমে দক্ষ শ্রমিক বাছাই করে নেওয়া হচ্ছে। কাজের বাহিরে যেসব শ্রমিক আছেন তাদের দেড় হাজার টাকা রেশন বাবদ দেওয়া হচ্ছে।

বড়পুকুরিয়া কয়লা ভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রধান প্রকৌশলী মো. আবু বক্কর সিদ্দিক জানান, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের তিনটি ইউনিট সচল রাখতে প্রতিদিন ৫ হাজার ২শ মেট্রিকটন কয়লার প্রয়োজন হয়। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে ৫২৫ মেগাওয়াট। বর্তামানে কয়লা সংকটের কারনে একটি ইউনিট অর্ধেক লোডে চালানো হচ্ছে। যা থেকে ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। যার জন্য প্রতিদিন প্রয়োজন হয় ১৬০০ মেট্রিকটন কয়লা। তবে তিনি বলেন, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের তিনটি ইউনিটের মধ্যে দুটি ইউনিট রেডি রয়েছে। একটি শাটডাউন অবস্থায় রয়েছে। সচল দুটি ইউনিট ফুল লোডে চালু রাখলে কয়লার প্রয়োজন হবে প্রতিদিন ৩৮০০ মেট্রিকটন। কয়লা খনি ও তাপবিদ্যুৎ ইয়ার্ডে বর্তমানে কয়লা মজুত রয়েছে ২ লাখ ১০ হাজার মেট্রিকটন। খনিকতৃপক্ষ পর্যাপ্ত কয়লা সাপ্লাই দিতে পারছেননা। এই মজুত দিয়ে ফুল লোডে দুটি ইউনিট চালু রাখলে দুই মাস বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হবে।  পর্যাপ্ত না থাকায় একটি চালু রাখা হয়েছে এবং বাকি দুটি বন্ধ রয়েছে।

এব্যাপারে বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানী লিমিটেড (বিসিএমসিএল) এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম সরকার এর সাথে কথা বললে বাদ পড়া শ্রমিকদের বিষয়ে তিনি বলেন, চীনা ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ভাল, দক্ষ শ্রমিক বাছাই করে পর্যায় ক্রমে কাজে যোগদান নিচ্ছেন। বর্তমানে কয়লা খনি থেকে ৫ হাজার টনের উপর কয়লা উত্তোলন হচ্ছে। যা দিয়ে কয়লা ভিত্তিক বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র সচল রাখা সম্ভব। কারণ তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে প্রতিদিন আড়াই থেকে তিন হাজার মেট্রিকটন কয়লার প্রয়োজন। করোনা পূর্ববর্তী সময় কয়লা উত্তোলন কাজে ১০৪৫ জন শ্রমিক দিয়ে যে পরিমাণ কয়লা উত্তোলন হতো বর্তামানে ৫শ শ্রমিক দিয়ে উৎপাদন কাজ ব্যহত হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওই সময় ১০৪৫ জন শ্রমিক থাকলেও কয়লা উত্তোলন কাজে সংযুক্ত থাকতেন ৬ শ থেকে ৭শত শ্রমিক। কাজেই উৎপাদন ব্যহত হওয়ার কোন সুযোগ নেই।

দেশের সব ক্ষেত্রে  করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও বড়পুকুরিয়া কয়লা খনিতে কেন তা হচ্ছে না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চীনা ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ঝুঁকি এড়াতে যা ভাল মনে করছেন সেভাবেই কাজ করছেন।