মাত্র নয় মাস বয়সে মাইশার (৫) ডান হাতের আঙ্গুল চুলার আগুনে পুড়ে যায়। সে সময় রংপুরে চিকিৎসা করে হাতের ক্ষত ভালো হলেও তিনটি আঙ্গুল কুকড়ে ছিল মাইশার। মেয়ের হাত ভালো হবে এমন আশা নিয়ে সম্প্রতি ঢাকার মিরপুরে ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের ডা. মো. আহসান হাবীব নামে এক চিকিৎসকের স্মরণাপন্ন হন মাইশার বাবা মোজাফফর। শিশুটির হাত দেখে চিকিৎসক বলেন, অপারেশন করলে মাইশার হাত স্বাভাবিক হবে।
সে অনুযায়ী গত বুধবার (৩০ নভেম্বর) সকালে ঢাকার রূপনগরে আলম মেমোরিয়াল হাসপাতালে হাতের অপারেশন হয় মাইশার। কিন্তু ঘন্টা দেড়েক পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায় শিশুটির অবস্থা খারাপ। তাকে আইসিইউ সাপোর্ট দেওয়ার জন্য গ্লোবাল স্পেশালাইজড হাসপাতালে নিতে হবে। হতবিহ্বল বাবা-মা মেয়েকে নিয়ে ছোটেন মিরপুর-১, মাজার রোডের সেই হাসপাতালে। সেখানে নেওয়ার পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায় শিশুটি মারা গেছে, তাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে।
ঘটনা এখানেই শেষ হয়নি। হতভাগ্য এই শিশুটির বাবা-মাকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অপারেশনের খরচ বাবদ নেওয়া টাকা ফিরিয়ে দেয়। মরদেহ বাড়িতে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্সও ঠিক করে দেয়। বাড়ি ফিরে যখন শিশু মাইশাকে দাফনের জন্য গোসল করানো হবে তখন গোসলে নিয়োজিত নারীরা দেখতে পান, মাইশার নাভির নিচে পুরো পেট জুড়ে কেটে সেলাই করা।
এ খবর ছড়িয়ে পড়লে শুরু হয় নানা গুঞ্জন। স্বজনরা পুলিশে খবর দেন। কিন্তু ঢাকায় অপারেশন হওয়ায় সংশ্লিষ্ট থানায় মামলার পরমর্শ দিয়ে পুলিশ ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। পরে নিরুপায় স্বজনরা শিশু মাইশাকে বাড়ির আঙ্গিনার কাছে দাফন করেন।
শুক্রবার (২ ডিসেম্বর) ভুক্তভোগী মাইশার বাড়িতে গিয়ে এসব তথ্য জানা গেছে।
মাইশার পুরো নাম মারুফা জাহান মাইশা। সে কুড়িগ্রাম পৌরসভার ৬ নং ওয়ার্ডের ভেলাকোপা ব্যাপারী পাড়ার মোজাফফর আলী ও বেলি আক্তার দম্পতির মেয়ে। মাইশার নানা ওসমান গণি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।
শুক্রবার সকালে মাইশার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় সেখানে শোকের মাতম চলছে। মেয়ের এমন 'অস্বাভাবিক' মৃত্যু কোনও ভাবেই মানতে পারছেন না তার বাবা-মা, স্বজন ও প্রতিবেশীরা। তারা মাইশার মৃত্যুর সঠিক কারণ তদন্ত করার দাবি জানান।
অপারেশনে মৃত্যুর শিকার মাইশার দিনমজুর বাবা মোজাফফর বলেন, 'মেয়ের হাতের আঙ্গুল ঠিক করার জন্য ঢাকার মিরপুরে ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের ডা. আহসান হাবীবের কাছে যাই। তিনি সবকিছু দেখে বলেন বুধবার (৩০ নভেম্বর) সকালে অপারেশন করা হবে। রূপনগরে আলম মেমোরিয়াল মেডিকেলে তার শেয়ার আছে জানিয়ে ডাক্তার বলেন, সেখানে অপারেশন করালে খরচ কম লাগবে। বুধবার সেখানে হাতের অপারেশন করার সময় মেয়ে মারা যায়। পরে তারা আমাদের টাকা ফেরত দিয়ে ধমক দিয়ে আমাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। বাড়ি এসে মেয়েকে গোসল করার সময় স্থানীয় মহিলারা দেখেন মেয়ের তল পেটের পুরো অংশ কেটে সেলাই করা।'
তিনি আরও বলেন, 'আমরা এটা দেখে নিরুপায় হয়ে পড়ি। আমরা গরিব মানুষ। কিছু বুঝি নাই। হাত অপারেশন করাতে গিয়ে তারা কেন আমার মেয়ের পেট কাটলো তা জানি না। আমাদেরকে কোনও কাগজপত্রও দেওয়া হয় নাই।'
মাইশার নিষ্প্রাণ দেহের গোসল করানো স্থানীয় নারী মফিজা খাতুন বলেন, 'মেয়ের হাতের আঙ্গুল কাটা ছিল। পরে গোসলের সময় দেখতে পাই ওর নিচ পেটের পুরো অংশ কেটে সেলাই করা। পরে সকলকে জানাই।'
মেয়ে হারানোর শোকে কাতর মাইশার মা বেলি বলেন, ' আমি কী ভুল করলাম! কেন মেয়েকে নিয়ে গেলাম। ওরা ডাক্তার না, কসাই। আমার মেয়ের পেট কাটলো কেন? ওরা আমার মেয়েকে মেরে ফেলছে। আমি এর বিচার চাই। আমি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে এর বিচার চাই।'
ভুক্তভোগী এই পরিবার ডা. আহসান হাবীবের একটি ভিজিটিং কার্ড দেয়। ওই কার্ডের নাম্বার ধরে মুঠো ফোনে যোগাযোগ করা হলে অপর প্রান্তের ব্যাক্তি নিজেকে ডা. আহসান হাবীব বলে দাবি করেন। মাইশার অপারেশন ও মৃত্যুর বিষয়ে জানতে চাইলে এই 'চিকিৎসক' বলেন, ' আমি অপারেশন করিনি। আমার শেয়ার থাকা আলম মেমোরিয়াল হাসপাতালে অপারেশন অ্যারেঞ্জ করে দেই। সেখানে ঢাকা মেডিকেলের প্লাস্টিক সার্জারির চিকিৎসক (সহকারী অধ্যাপক) ডা. শরিফুল ইসলাম অপারেশন করেন। কিন্তু দুর্ঘটনা বশত শিশুটি মারা যায়। আমি নিজেও এ ঘটনায় শক্ড।'
হাতের আঙ্গুল অপারেশন করার সময় পেট কাটার বিষয়ে জানতে চাইলে ডা. আহসান হাবীব বলেন, ' এটা শিশুটির পরিবারকে জানিয়ে করা হয়েছে। হাতের আঙ্গুল অপারেশন করে ওই স্থানে স্কিন সংযুক্ত করার জন্য পেট থেকে স্কিন নেওয়া হয়েছিল।'
' পরিণত বয়সের মানুষের ক্ষেত্রে পায়ের থাই থেকে চামড়া নেওয়া হয়। কিন্তু শিশুটির থাই সরু থাকায় তার পেট থেকে চামড়া নিয়ে সেলাই করে দেওয়া হয়েছিল।' যোগ করেন তিনি।
তাহলে হাতের অপারেশন করতে গিয়ে মাইশার মৃত্যুর কারণ কী, এমন প্রশ্নে এই 'চিকিৎসক' বলেন,' আমি নিজেও অপারেশন থিয়েটারে প্রায় আধা ঘন্টা ছিলাম। সবকিছুই স্বাভাবিক ছিল। পরে আমি আমার বাসায় চলে যাই। পরে শিশুটির মৃত্যুর কারণ জানতে ওই সার্জনের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি জানিয়েছেন, সম্ভবত অ্যানেস্থিসিয়ার কারণে শিশুটির মৃত্যু হয়ে থাকতে পারে। আসলে বেশিক্ষণ এনেস্থেটিক অবস্থায় থাকায় হয়তো সহ্য করতে পারেনি। এখানে অন্য আর কোনও কারণ নেই। তবে পুরো ঘটনায় আমি নিজেও মর্মাহত।'
নিজেকে কুড়িগ্রামের (নাজিম খাঁ) সন্তান দাবি করে ডা. মো. আহসান হাবীব বলেন, 'রোগীটা আমার এলাকার। কুড়িগ্রামের যেকোনও লোক আসলে আমি হেল্প করি। আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। এটা আসলে এ্যাকসিডেন্ট। তারপরও মেনে নেওয়া কঠিন। আমি নিজেও সেদিন স্তব্ধ হয়ে গেছি।'
নিজের পরিচয় সম্পর্কে ডা. মো. আহসান হাবীব জানান, তিনি বিসিএস ২৫ ব্যাচের চিকিৎসক। বর্তমানে জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনিস্টিটিউট ও হাসপাতাল, মহাখালীতে সহকারী অধ্যাপক (সার্জারী) হিসেবে কর্মরত। ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল, মিরপুরে তার চেম্বার। জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনিস্টিটিউট ও হাসপাতালের ওয়েব সাইটে দেওয়া তথ্য মতে ডা. মো. আহসান হাবীব ওই হাসপাতালের ইমার্জেন্সি অনকোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। তবে সাইটে তার কোনও ছবি পাওয়া যায়নি।