ফ্রিডম বাংলা নিউজ

শুক্রবার, অক্টোবর ১৮, ২০২৪ |

EN

প্রায় দু'শ বছরের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে "বরিশাল ব্রাক্ষ্ম সমাজ"

ফিচার ডেস্ক | আপডেট: বুধবার, নভেম্বর ৩০, ২০২২

প্রায় দু'শ বছরের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে "বরিশাল ব্রাক্ষ্ম সমাজ"
১৬১ বছরে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে বরিশাল শহরের মূল প্রাণ কেন্দ্রে দাড়িয়ে বরিশাল তথা বংলা নবজাগরণ অন্যতম প্রতীক বরিশাল ব্রাক্ষ্ম সমাজ উপাসনালয়। বেশি পুরাতন এই ঐতিহ্য সংরক্ষনের অভাবে কালের পরিক্রমায় ধবংসের দ্বার প্রান্তে। 

দীর্ঘ বছর মেরামত, যত্ন  না করায় বর্তমানে এটা ব্যবহার অনুপযোগী,জরাজীর্ণ,মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ন অবস্থায় আছে। ব্রাক্ষ্মসমাজ মূল ভবনটি বর্তমানে ব্যবহার অনুপযোগী হলেও এর আশেপাশের ভবন গুলোতে এখনও কিছু মানুষ বসবাস করেন। মূল ভবনটি এখন স্থানীয় দোকানদারদের গোডাউন এবং এর পাশের একটি কক্ষ তানসেন সংগীত বিদ্যালয়ের কাজে ব্যবহার করা হয়।

রাখাল বাবুর দ্বিতীয় ভ্রাতা বিহারী লাল রায় খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেন। পিতা রাজচন্দ্র পুত্রদের ধর্ম ত্যাগের কথা শুনে বিক্ষুব্ধ হলেন এবং বাসায় ব্রাহ্ম প্রার্থনা বন্ধ করে দিয়ে পুত্রদের প্রায়শ্চিত্ত করতে বাধ্য করেন। এমনকি তিনি কন্যাদের শিক্ষা বন্ধ করে দেন। ১৮৬৫ খৃৃস্টাব্দে বিক্রমপুরের দুর্গামোহন দাশ বরিশালে আগমন করেন এবং ব্রাহ্ম সমাজের প্রচার এগিয়ে নিয়ে যান। বিক্রমপুরের গিরীশ চন্দ্র মজুমদার, সর্বানন্দ দাশ ও ডাক্তার আনন্দচরণ খাস্তগীর দুর্গামোহনের সাথে যোগ দেন। বরিশালের ব্রাহ্ম সমাজের অগ্রগতির ইতিহাসে তারা বিশেষ অবদান রেখেছেন। ব্রাহ্ম সমাজের সভাপতি হলেন দুর্গামোহন দাশ, সম্পাদক সর্বানন্দ দাশ, প্রচারক গিরীশ চন্দ্র মজুমদার এবং কার্যকরী সমিতির সদস্য স্কুলের হেডমাষ্টার জগবন্ধু সাহা। ব্রাহ্ম সমাজের মন্দিরের জন্য চণ্ডীচরণ রায় চৌধুরী এক খণ্ড জমি দান করেন। ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দের ১ নভেম্বর আলেকান্দা নব আদর্শ স্কুলের নিকট মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯২৩ খৃৃস্টাব্দে সদর রোডের নিকট ব্রাহ্ম মন্দিরের ভবন নির্মাণ করা হয়। ১৮৬৫ খৃৃস্টাব্দে রাখাল বাবুর স্ত্রী সৌদামিনী, ভ্রাতা বিহারী লাল রায় ও প্যারীলাল রায় ব্রাহ্ম সমাজে যোগ দেন। এ সকল ঘটনা অবলম্বন করে ব্রাহ্ম আন্দোলনের নেতাদের ওপর নির্যাতন নেমে আসে। তাদেরকে সমাজচ্যুত এবং একঘরে করা হয়। এ সংগ্রামের দিনে বরিশালের ব্রাহ্ম মহিলারা কুসংস্কার দূরীকরণে অগ্রণী হয়েছিলেন। রাখাল বাবুর স্ত্রী সৌদামিনী দেবী, দুর্গামোহনের স্ত্রী ব্রহ্মময়ী দেবী, মনোরমা মজুমদার ও মুক্তাকেশী দেবী প্রকাশ্যভাবে স্ত্রী শিক্ষা ও স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেন। ১৮৭০ খৃৃস্টাব্দে দুর্গামোহন দাশ বরিশাল ছেড়ে কলকাতায় ওকালতি করতে যান। দুর্গামোহনের পর জেলা স্কুলের হেড মাষ্টার জগবন্ধু লাহা ব্রাহ্ম সমাজের পরিচালনার ভার নেন।

১৮৮২ খৃৃস্টাব্দে অশ্বিনী কুমার দত্ত ব্রাহ্ম সমাজের সভ্য হন এবং ছাত্র সমাজের উন্নতির জন্য বিভিন্ন সময় এনিয়ে বক্তৃতা দেন। ১৮৮৮ খৃৃস্টাব্দে ব্রাহ্ম সমাজের মাঘোৎসবের সময় ইংরেজীতে বক্তৃতা দেন। যুব সমাজ অশ্বিনী কুমারের সত্য প্রেম পবিত্রতার আদর্শ গ্রহণ করে। ব্রাহ্ম সমাজের উদ্যোগে সেবক দল গঠন করা হয়। ধর্ম ও নীতি শিক্ষার জন্য ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে ছাত্র সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৮৮৫ খৃৃস্টাব্দে তা ছাত্রদের সেবাব্রতী প্রতিষ্ঠান নামে পরিণত হয়।

রূপসী বাংলার কবি জীবননান্দ দাশ ও তার মা কবি কুসুম কুমারী দাশসহ তাদের পরিবারও এই ব্রাক্ষ্ম সমাজের মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন এবং ব্রাক্ষ্ম উপাসনা করতে। জীবনানন্দ দাশ এর পিতামহ" সর্বানন্দ "ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেন। জীবনানন্দের শৈশবে বরিশালে ব্রাহ্মসমাজের সভা হত প্রায়ই। তার মা, বাবা প্রায়ই সভাতে আচার্যের দায়িত্ব পালন করতেন। জীবনানন্দ সে সব সভায় উপস্থিত থাকতেন। এছাড়াও ব্রাহ্ম ধর্মানুসারীরা এ সভায় উপস্থিত থাকতেন । জীবনানন্দ ধর্মনীতি ও শিক্ষামূলক ছোট ছোট কবিতা পাঠ করতেন। 

এছাড়াও  তৎকালীন মুসলিম পন্ডিত ব্যক্তিরা এই ব্রাক্ষ্ম উপাসনালয় উপাসনার জন্য আসতেন।

ব্রাক্ষ্মসমাজ ধর্মীয় কুসংস্কারের পাশাপাশি বিভিন্ন  সামাজ সংস্কারে মূখ্য ভুমিকা রাখে। ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে কেশবচন্দ্র সেনের প্রচেষ্টায় বয়স্কা নারীদের শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা ও ব্রাহ্ বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। ব্রায়সমাজ বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলেছিল। ব্রাম্মসমাজের প্রচেষ্টায় ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে তিন আইন দ্বারা বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহ রদ এবং বিধবা বিবাহ ও অসবর্ণ বিবাহ চালু হয়।

ব্রাম্মসমাজ ত্রাণের কাজেও সেবার কাজে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। ব্রাম্মসমাজ সমাজ সংস্কারের কার্যে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করে। তাদের নীতিবােধ, যুক্তিবাদ ও নিজস্ব মতামত ব্যক্তিকে আত্মবিকাশের পথে নিয়ে যায়। এরা জাতিভেদ প্রথা, অস্পৃশ্যতার বিরােধিতাকে করে অনেকটাই সফলতা অর্জন করে। মদ্যপানের কুফল সম্পর্কেও জনগণকে সাবধান করে দেবার জন্য মদ না গরল’ নামক পত্রিকা। প্রকাশ করে প্রচার চালানাে হয়। শ্রমিকদের জন্য ব্রাম্মসমাজ নীতিবােধ প্রচার করে।

এ বিষয়ে অমৃত লাল দে মহাবিদ্যালয় সাবেক প্রিন্সিপাল তপংকর চক্রবর্তী বলেন, "ব্রাক্ষ্ম সমাজ মূল চেতনা একেশ্বরবাদ হলোও এটি ছিল সামাজিক আন্দোলন। ১৮২৮-১৮৫০ সালের দিকে এই আন্দোলন সংগঠিত হয়। ঐ সময়ের ভারতীয় উপমহাদেশের সাধারণ মানুষের নীতি ও নৈতিকতা অনেক অভাব ছিলো। যার প্রভাবে ধর্মীয় কুসংস্কার এতটাই বেড়ে যায় যে, সমাজ ভঙ্গুর অবস্থায় পরিণত হয়। মূলত ধর্মীয় কুসংস্কার এর হাত থেকে সমাজকে রক্ষা করার জন্য এই ব্রাক্ষ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। 

যেটি তৎকালীন সময়ে শিক্ষা ও সংস্কৃতিসহ সমাজের মধ্যেস্থ বিভিন্ন কুসংস্কার এবং কুপ্রথা দূর কর করতে উল্লেখযোগ্য ভুমিকা পালন করেন। এবং রাজা রামমোহন রায়, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, শীবনাথ শাস্ত্রী, আনন্দমোহন বসু, কেশবচন্দ্র সেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অশ্বিনী কুমার দত্তসহ তৎকালীন সকল জ্ঞানীব্যক্তিরাই এই ব্রাক্ষ্ম মতাদর্শী ছিলেন।"

এছাড়া বরিশালের স্থায়ী বাসিন্দা ও বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সাবেক প্রধান অর্থ ও হিসাব কর্মকর্তা কাজী মিজানুর রহমান বলেন, "আমরা ছোট বেলা দেখেই এটিকে এভাবে দেখে আসছি, তবে আমি 'দি ডিস্ট্রিক্ট অব বাকেরগঞ্জ ও অনন্য জীবনানন্দ' গ্রন্থে এই বিষয়ে সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গভাবে জানতে পারি। এরপর বিভিন্ন সময় এটি নিয়ে লেখালেখি করি। তবে দীর্ঘ বছর মেরামত, যত্ন  না করায় বর্তমানে এটা ব্যবহার অনুপযোগী, জরাজীর্ণ, মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ন অবস্থায় আছে। বেশি পুরাতন হওয়ার এটি সংরক্ষনের অভাবে কালের পরিক্রমায় ধবংসের দ্বার প্রান্তে। ব্যবস্থাপনা কমিটিতে কারা আছেন  তা জানা যায় নাই। তবে ধংসস্তুপে পরিনত হওয়ার আগে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ইতিহাসের  উপাদানটিকে বাঁচিয়ে রাখা উচিৎ। এর জন্য জাতীয় যাদুঘর কর্তৃপক্ষ, জেলা পরিষদ, বরিশাল জেলাপ্রশাসক বরিশাল, তথা সরকারের দৃষ্টি আকর্ষন করছি।"

কোন জনপদের  ঐতিহ্যকে এক প্রজন্ম থেকে আর এক প্রজন্মের কাছে পৌছে দেয় ইতিহাস। পরবর্তি প্রজন্ম যাতে প্রকৃত ঘটনা ভুলে না যায় একারনে ব্রাহ্মসমাজ এর ঐতিহ্য ও ইতিহাস রক্ষা করা আবশ্যক। বর্তমান ব্রাক্ষ্ম উপাসনালয়টি সংস্কার করা না গেলে হারিয়ে যাবে বরিশাল তথা বাংলা নবজাগরণ এই স্মৃতি চিহ্ন।

মো. আজম খান
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়।