প্রতিটি মানুষ যেমন একে অপরের থেকে ভিন্ন, তেমনি প্রত্যকেই ভিন্নভিন্ন আঙ্গিকে নিজেদের জীবন থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। তবে একটি ব্যাপার নিশ্চিত, কেউ যদি নিজেদের জীবনের বিশাল একটি সময় দুঃখের সঙ্গে যাপন করা শুরু করেন, তখন তিনি আর একাকী বোধ করেন না। দুঃখ যেন তার চিরসঙ্গী হয়ে পাশে রয়ে যায়।
মানুষ হিসেবে আমরা ইতিবাচক আবেগের চেয়ে নেতিবাচক আবেগেই দ্রুত সাড়া দেই। মনোবিজ্ঞানে এই প্রবণতাকে নেতিবাচকতাকে ধারণ করার পক্ষপাত হিসেবে দেখা হয়। মস্তিষ্কের একটি প্রবৃত্তি হল- এটি নেতিবাচক ঘটনাবলি ও অনুভূতিকে অধিকতর স্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ করে রাখে। কিন্তু ইতিবাচক বা সুখীবোধ করার অনুভূতিগুলোকে সে তুলনায় কমই মনে রাখা হয়।
সম্প্রতি মেরিইলে পোয়েটারিং নামের একজন বিখ্যাত মানসিক চিকিৎসাবিদ ও প্রশিক্ষক এক সাক্ষাৎকারে নিজের পেশাগত জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য দিয়েছেন। তিনি সাইকোসোমাটিক নামক মানসিক রোগে ভোগা ও মানসিক ট্রমা, নেতিবাচকতার সঙ্গে লড়াই করা প্রচুর রোগীর চিকিৎসা করেছেন। তার এই সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে মানুষের নেতিবাচক ভাবনাগুলোর উদ্ভব ও এ সম্পর্কিত নানান অজানা দিক। মানুষ কীভাবে নেতিবাচকতাকে দূরে ঠেলে সুখী বোধ করতে পারে তা নিয়েও তিনি দিয়েছেন নানান তথ্য।
কেন আমরা সুখের চেয়ে দুঃখের কথা বেশি মনে রাখি?
প্রতিটি মানুষের আবেগ-অনুভূতিকে একই দাড়িপাল্লায় মাপা যায় না। সব মানুষ একইভাবে আবেগ-অনুভূতি বোধও করে না। কারও আবেগ তীব্র হতে পারে অন্যদের তুলনায়। কেউ আবার সুখবোধে তীব্রতা অনুভব না করলেও দুঃখের সময় মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন। কিন্তু বেশিরভাগ লোকের ক্ষেত্রে ইতিবাচক আবেগে সাড়া দেওয়ার চাইতে নেতিবাচক সময়টাকে বেশি মনে রাখতে দেখা যায়।
কেন এমনটি হয়?
সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবতে গেলে, আমরা সকলেই চাই নেতিবাচক বিষয়গুলোকে দূরে সরিয়ে ইতিবাচক ভালো কিছুকে গ্রহণ করতে। শোক, বিচ্ছেদ, বেদনার মতো অনুভূতিগুলো আমাদের জন্য ভালোর চেয়ে খারাপটা বেশি বয়ে আনে। হয়তো সুখ আমাদের জন্য হুমকিস্বরুপ নয়, এবং এটাকে মোকাবেলা করতে আমাদের নিজেদেরকে শক্তভাবে প্রস্তুত করতে হয়না। তাই যেটা আমাদের মনে খারাপ অনুভূতির সঞ্চার করে ও দাগ কেটে যায়, তা আমরা সহজে ভুলি না। আবার অনেকেই আছেন, যারা জানেনই না কীভাবে পরিপূর্ণভাবে সুখ উদযাপন করতে হয়।
আমরা যদি আমাদের মধ্যে ইতিবাচক আবেগ-অনুভূতিগুলোকে আরও গভীরভাবে ধারণ করার অভ্যাস গড়ে তুলি, তাহলে আমরা আনন্দকে আরও তীব্রভাবে উপলব্ধি করতে শিখবো। অন্যদিকে, আমাদের খারাপ সময়গুলোতে চুপচাপ হাতগুটিয়ে বসে থেকে কাটিয়ে দিলেই তা ঠিক হয়ে যায়না। যদি সেই খারাপ পরিস্থিকে আমরা মোকাবেলা না করি, তাহলে তা আমাদের মধ্যে সুপ্তাবস্থায় ঘাঁটি গেড়ে বসতে পারে। যা একসময় মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে এবং আমাদের মানসিক রোগে পরিণত হতে পারে।
নেতিবাচক অনুভূতিগুলো যেভাবে শারীরিকভাবে প্রকাশ পায়
অনেকেই আছেন যারা মানসিক ভঙ্গুরতার সময়গুলোতে নিজেদেরকে শক্তভাবে উপস্থাপন ও ধরে রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু প্রায় সময় তা সম্ভব হয়না, যা অনেক ক্ষেত্রেই স্বাস্থ্যের ওপর আঘাত হানে। যেমন-হঠাৎ করে কেউ কিছু জানতে পেরে মন ভেঙ্গে যায় এবং মানসিকভাবে ধাক্কা খান। তখন তাদের মনের আঘাত থেকে বুকে ব্যথা অনুভূত হতে পারে, যেটাকে অনেকে হার্ট অ্যাটাক ভেবে বসেন। প্রচন্ড চাপ ও কষ্ট পাওয়ার কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে।
জীবনে খারাপ ও কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখী হওয়াটা জরুরী। কারণ খারাপ অভিজ্ঞতার থেকেই আমরা আমাদের জীবনের ভালো অনুভূতি ও মুহূর্তগুলোকে আরও গভীরভাবে উপোভোগ করতে শিখি। কিন্তু আমাদের সেই খারাপ সময়গুলোকে মোকাবেলা করা শিখতে হবে, তবে সেগুলোকে দমন করে না রাখাই ভালো। কারণ অবদমিত আবেগ জমতে জমতে একসময় রাগে পরিণত হয়। যা মানুষকে সাইকোসোমাটিক নামক মানসিক রোগের দিকে ধাবিত করে।
বার বার দুঃখ অনুভূব করার মাধ্যমে কি প্রকাশ পায়?
কেউ যখন বারবার দুঃখ অনুভব করতে থাকেন, তখন সেটির একটি কারণ হতে পারে তার দুঃখের প্রক্রিয়াকরণ তখনো শেষ হয়নি। যেমন হৃদয় ভাঙ্গার দুঃখবোধ শেষ হতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। এটি রাগ, লজ্জা ও অন্যান্য আবেগ অনুভূতির সাথে বারবার ফিরে এসে আপনাকে আঘাত করবে। আর তখন চাইলেই কেউ তার মন থেকে সেই ব্যক্তিকে মুছে ফেলতে পারেনা, যে একসময় তার কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
লজ্জা, নিম্ন আত্মমর্যাদাবোদের মতো নেতিবাচক বিষয়গুলো আমরা যেকোনো মূল্যে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। যদিও সেগুলোকে পুরোপুরি মোকাবেলা আমরা কেউই করতে পারিনা এবং এগুলো আমাদের মধ্যেই বিদ্যমান থাকে। দুঃখবোধটা ওগুলোর মতো এতটা নেতিবাচকভাবে সমাজে অগ্রহণযোগ্য নয় বলে, আমরা সেটিকে সাদরে গ্রহণ করি এবং দুঃখ বিলাসে নিজেদেরকে আবদ্ধ করে ফেলি।