ফ্রিডম বাংলা নিউজ

বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ২১, ২০২৪ |

EN

উপস্থিতি কলমে, অনুপস্থিতি কাঠপেন্সিলে

ঝালকাঠি, প্রতিনিধি | আপডেট: বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ৩, ২০২২

উপস্থিতি কলমে, অনুপস্থিতি কাঠপেন্সিলে
উপস্থিতি কলমে অনুপস্থিতি কাঠপেন্সিলে মহিলা সংস্থার প্রশিক্ষনার্থী কাগজে আছে বাস্তবে নেই।

তৃণমূল পর্যয়ে অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে নারী উদ্যোক্তাদের বিকাশ সাধন প্রকল্প-৪ এর আওতায়   ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলায় জাতীয় মহিলা সংস্থার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে চলছে নারী উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ। অভিযোগ রয়েছে, এখানে ভর্তি নির্দেশনা অনুযায়ী চলতি ব্যাচে পৃথক পাঁচটি ট্রেডে ৫০ জনকরে মোট আড়াইশো প্রশিক্ষনার্থী থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা নেই। 

তবে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ভর্তি ফরম এবং হাজিরা খাতায় মিথ্যে তথ্য দিয়ে ২৫০ জনের নাম লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। কারন প্রশিক্ষণ শেষে এখান থেকে প্রত্যেক প্রশিক্ষণার্থীর জন্য সরকারী বরাদ্দ রয়েছে নগদ ১২ হাজার টাকা। 


বিষয়টি নিয়ে ১মাস অনুসন্ধান করেছে ফ্রিডমবাংলানিউজ। প্রমান মিলেছে অভিযোগের সত্যতার। এই প্রশিক্ষণে বিভিন্ন নামে-বেনামে শিক্ষার্থী দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা লোপাটের পায়তারা করছেন সেখানকার প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা সামিরা আক্তার। নাম প্রকাশ না করার শর্তে অনেক প্রশিক্ষণার্থী ফ্রিডমবাংলানিউজের কাছে ঘটনার সত্যতাও স্বীকার করেছেন।

প্রকল্পের আওতায় বর্তমান ব্যাচে যে সকল ট্রেডে নারী উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ দেয়ার কথা ছিলো । তাহলো চারমাস মেয়াদী বিউটিফিকেশন কোর্স, কেটারিং কোর্স, ইন্টেরিয়র ডিজাইনিং এন্ড ইভেন্ট   ম্যানেজমেন্ট কোর্স, ফ্যাশন ডিজাইনার কোর্স। এছাড়া ৪০ দিন মেয়াদী বিজনেস ম্যানেজমেন্ট এন্ড ই-কমার্স কোর্স। 

ফ্রিডমবাংলানিউজের অনুসন্ধানে যে তথ্য বেরিয়ে এসেছে।  তাহলো এই কেন্দ্রের যাবতীয় কাগজ এবং হাজিরা খাতায় প্রতিটি ট্রেডেই ৫০ জন করে প্রশিক্ষনার্থী ভর্তি দেখানো হয়েছে। প্রশিক্ষণ শেষে ভূয়া নাম গুলোর মাথাপিছু ১২ হাজার টাকা যাবে প্রশিক্ষণ কর্মকর্তার পেটে আর লোপাটের ঐ অর্থের একটা অংশ ভাগ পাবে সেখানকার ছয়জন প্রশিক্ষক এবং নৈশপ্রহরীও।   

এই কেন্দ্রে প্রশিক্ষনার্থীদের টাকা ব্যাংক একাউন্ট  বা মোবাইল একাউন্টে না দিয়ে নগদ দেয়া হয়। আর সুযোগ বেছে নিয়েছে প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা সামিরা আক্তার। নগদ টাকা দেয়ার তথ্যটি ফ্রিডমবাংলাকে নিশ্চত করেছে জাতীয় মহিলা সংস্থা ঝালকাঠির জেলা কর্মকর্তা মো.ফরহাদ হোসেন হাওলাদার।

গেলো মাসের ২৮ তারিখ সকাল ১১ টায় রাজাপুর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে সরজমিনে গিয়ে দেখাযায় সেখানে ৪টি ট্রেডের প্রশিক্ষণার্থীদের চুরান্ত পর্বের পরীক্ষা চলছিলো। এই কেন্দ্রে ছয়জন প্রশিক্ষক থাকার কথা থাকলেও ঐ সময় মাত্রদুজন প্রশিক্ষক উপস্থিত ছিলেন। এমনকি সেখানকার দায়িত্বরত প্রশিক্ষন কর্মকর্তা সামিরা আক্তার নিজেও অনুপস্থিত ছিলেন। আর ভেতরে ৩টি কক্ষে ৪৬ জন নারী পরীক্ষা দিচ্ছিলেন। 

প্রশিক্ষন কর্মকর্তা কেনো উপস্থিত নেই তা জানতে   চাইলে সেখানে থাকা বিউটিফিকেশন ট্রেডের প্রশিক্ষক মোসাম্মৎ শাহানারা খাতুন বলেন,'ম্যাডাম ছুটিতে আছেন।'

তাৎক্ষনিক খোঁজ নিয়ে যানাগেলো ২/৪ দিনে তার কোনো ছুটি মঞ্জুর করেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। সাংবাদিক উপস্থিতি টের পেয়ে প্রশিক্ষন কর্মকর্তা দ্রুত প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে চলে আসেন।

আড়াইশো প্রশিক্ষনার্থীর স্থলে বর্তমানে ৪৬ জন নারীকে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে এ বিষয়ে তার কাছে জানতে চায় ফ্রিডমবাংলানিউজ। প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা সামিরা আক্তার বলেন,'দুইমাস ক্লাস চালানোর পর কেন্দ্রের নির্দেশে ৪০দিন মেয়াদী বিজনেস ম্যানেজমেন্ট এন্ড ই-কমার্স কোর্সটি বন্ধ আছে।  আর তাই ভর্তি এবং হাজিরা খাতায় তাদের ৫০ জনের নাম রয়েছে, কিন্তু তারা উপস্থিত নেই। বাকি ৪টি ট্রেডে ৫০ জন করে ২০০ জন ভর্তি থাকলেও কেন্দ্রের নির্দেশে বিকেলের ক্লাসও বন্ধ রয়েছে। সে কারনে বর্তমানে সকালে ১০০ জন প্রশিক্ষনার্থীর ক্লাশ চলমান রয়েছে। সেই ১০০ জন নারীর মধ্যে বিভিন্ন কারনে আজ পরীক্ষা দিতে আসতে পারেনি।'

এদিকে প্রশিক্ষণার্থীদের হাজিরা খাতার কিছু অংশ সংগ্রহ করেছে ফ্রিডমবাংলা। তাতে দেখা যায় প্রকৃত যে প্রশিক্ষণার্থী রয়েছে তাদের উপস্থিতির ঘরে বলপেন দিয়ে স্বাক্ষর করানো হয় এবং অনুপস্থিতের ঘরে কাঠপেন্সিল দিয়ে ক্রসচিহ্ন দেয়া হয়।  

এ থেকে জানাগেলো প্রকৃত যারা প্রশিক্ষনার্থী রয়েছে তাদের ক্লাসে অনুপস্থিতির দিনগুলোতে ১৫০ টাকা করে কেটে রাখা হবে। কিন্তু টাকা কেটে দিয়ে কাঠ পেন্সিলের ক্রসচিহ্ন রাবার দিয়ে মুছে স্বাক্ষর বসিয়ে ঐ টাকাও সামিরা আক্তারের নেতৃত্বে তুলে নিবে প্রশিক্ষকরা। হাজিরা খাতায় কেনো কাঠপেন্সিল দিয়ে ক্রসচিহ্ন দেয়া হলো সে বিষয় প্রশ্ন করলে কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকেন সামিরা আক্তার। 

রাজাপুরের কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেলো ষাটোর্ধ্বো নারীরাও পরীক্ষা দিচ্ছেন বিউটিফিকেশন ট্রেডে। তবে ক্যামেরার সামনে সবাই লিখা বন্ধ করে বসেছিলো। যে জিনিসটি লক্ষ্য করা গেছে, তাহলো পরীক্ষার্থীদের বেশিরভাগ নারীর হাতের লেখা একই রকম। এ থেকে বোঝা গেলো পরীক্ষার খাতা নির্ধারিত কেউ লিখে দিয়েছে। কারণ অনুসন্ধানে যা পাওয়া গেলো তা হলো অনেক পরীক্ষার্থী জানেনা তারা কি পরীক্ষা দিতে এসেছে। গোপন একটি সুত্র জানিয়েছে দুই বা তিন হাজার টাকার বিনিময়ে গ্রামের অনেক গৃহীনিরা পরীক্ষা দিতে এসেছে। অথচ তাদের নামেও বরাদ্দ হবে ১২ হাজার টাকা। 

পরীক্ষা কেন্দ্রের একটি কক্ষে গিয়ে দেখা গেছে যাটোর্ধো নারীরাও ফ্যশন ডিজাইনার ট্রেডে পরীক্ষা দিতে এসেছে। মাকসুদা বেগম নামের পঞ্চাশোর্ধো এক প্রশিক্ষনার্থীকে প্রশ্ন করা হয়, 'আপনি কোন ট্রেডে পরীক্ষা দিয়েছেন' তিনি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে কোনো উত্তর না দিতে পেরে কেন্দ্র থেকে চলে যায়।

ফ্রিডমবালার  সাথে এবিষয়ে মুঠোফোনে কথা হয় প্রকল্পের তথ্য প্রদানকারী কর্মকর্তা সহকারী  প্রোগ্রামার মো.সাদাত হোসেনের সাথে। তিনি বলেন, সকল ট্রেডে ভর্তি সংক্রান্ত বিষয়ে মন্ত্রনালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রত্যেক প্রশিক্ষণার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতা নুন্যতম অষ্টম শ্রেনী পাস হতে হবে এবং ১৮ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে প্রশিক্ষণার্থীর বয়সসীমা হতে হবে।

এই প্রকল্পের সহকারী পরিচালক (প্রশিক্ষণ ও মূল্যায়ণ) মো. কাইয়ুম মিয়া মুঠোফোনে   ফ্রিডমবাংলাকে বলেন, 'বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কারনে আমাদের প্রকল্পের বাজেট মন্ত্রনালয় থেকে অর্ধেক করে দিয়েছে। আর তাই প্রকল্পে ব্যায় সংকোচন করতে সকল প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে বিকেলের ক্লাস স্থগিত করা হয়েছে। শুধু সকালের ক্লাশে ১০০ জন প্রশিক্ষনার্থী অংশগ্রহন করবে। তবে রাজাপুর কেন্দ্রে সকালেও ১০০ জন কেনো নেই সে বিষয়ে   ওখানকার দায়িত্বরত কর্মকর্তার কাছে জানতে চাওয়া হবে।'