ক্রীড়াঙ্গনের পরিচিত মুখ বাফুফের সাবেক কর্মকর্তা আহমেদ সাইদ আল ফাত্তাহ ভাইয়ের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ফাত্তাহ ভাইয়ের জন্ম না হলে বা তার সহযোগিতা না পেলে আমি ফুটবলার হতে পারতাম না। তিনি আমাকে ফুটবল চিনিয়েছেন, আমার পায়ে হাত দিয়ে ফুটবল খেলা শিখিয়েছেন। জাতীয় দলে খেলার সুযোগ করে দিয়েছিলেন তিনি। আমার সব অর্জনের পেছনে পুরো অবদান ফাত্তাহ ভাইয়ের। নিজের সন্তানের মতো দেখভাল করতের আমাকে। আমার সাফল্যে সবসময় আমার চেয়েও বেশি খুশী হতেন ফাত্তাহ ভাই। ভাইয়াকে খুব মিস করি। ভাইয়ার অকাল মৃত্যু আজও মেনে নিতে পারিনা। কান্নাজড়িত কণ্ঠে এসব কথা বলছিলেন সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপাজয়ী দলের সদস্য কুষ্টিয়ার মেয়ে নিলুফা ইয়াসমিন নিলা।
নিলা বলেন, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আমরা এশিয়ান কাপ কোয়ালিফাই খেলতে যায় উজবেকিস্তানে। ওখানে লাস্ট ম্যাচ হয় জর্ডানের বিরুদ্ধে। সেখানে আমরা ৫-০ গোলে হেরে যায়। হেরে যাওয়া ও আমাকে নিয়ে ২২ সেপ্টেম্বরে ফাত্তাহ ভাই স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। আর ২৩ সেপ্টেম্বর ভোরে তিনি স্ট্রোক করে মারা গেছেন। তিনি আমাকে খুব স্নেহ করতেন, ভালোবাসতেন। আমি তাকে কখনোই ভুলতে পারবো না। তিনিই আমাকে ফুটবল খেলার সাথে পরিচিত করিয়ে দেন। আমাকে ফুটবল খেলায় এনেছেন তিনি। তিনি আমার পায়ে হাত দিয়ে ফুটবল খেলা শিখিয়েছে। ফুটবলার হওয়ার পিছনে পুরো অবদান তার। সে না থাকলে আমি ফুটবলার হতে পারতাম না।
নিলা আরও বলেন, ফাত্তাহ ভাই ২০১২ সালে ব্যক্তিগত উদ্যোগে কুষ্টিয়ায় মেয়েদের ফুটবল খেলা শেখাতে আসেন। আমি তখন ৫ম শ্রেণীর ছাত্রী। ফাত্তাহ ভাই ঢাকা থেকে কুষ্টিয়ায় এসে আমি সহ ৫ থেকে ৬ জন মেয়েদের ডেকে ফুটবল খেলার ব্যাপারে কথা বলেন এবং ফুটবল উপহার দেন। সেদিন নতুন ফুটবল হাতে পেয়ে আমি খুবই খুশী হলাম। ফুটবল খেলার প্রতি আগ্রহী হলাম। এরপর তিনি আমার পায়ে হাত দিয়ে ফুটবলে লাথি দেয়া শেখাতেন। একটা একটা করে বল পাচিং, স্কিল, লাথি দেয়া সহ বিভিন্ন আইটেম শেখাতেন। ল্যাপটপে বিশ্বের বিভিন্ন বড় বড় খেলোয়াড়দের খেলা দেখাতেন, নিয়ম ও খেলা শেখাতেন। প্রতিদিন দুইবেলা অনুশীলন করাতেন।একবেলা থানাপাড়া মাঠে আর একবেলা গড়াই নদী বালুর চরে অনুশীলন করাতেন ফাত্তাহ ভাই। অল্প সময়ের মধ্যে ফুটবল খেলার দক্ষতা অর্জন করালেন। আমি তার কাছে চির কৃতজ্ঞতা। আল্লাহ তাকে বেহেশতবাসী করুক।
এভাবে তিনি ২০১৬ সাল পর্যন্ত আমাকে খেলা শেখাতেন। জার্সি, বুট, বল কিনে দিতেন। পুষ্টিকর খাবার খাওয়াতেন। উনি শুধু মেয়েদের খেলা শেখানোর জন্য কুষ্টিয়ায় এসেছিলেন। তিনি ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় বসবাস করতেন। তার জন্মস্থান কুষ্টিয়ায়।
এলাকার মানুষ ভাইকে অনেক খারাপ কথা বলতেন। তখন ভাইয়া আমাকে বলতেন, দেখো তোমাকে নিয়ে একসময় তারা গর্ব করবে এবং ভালো ভালো কথা বলবে। আজ ভাইয়ার কথাই সত্যি হয়েছে। সে বেঁচে থাকলে আজ অনেক খুশী হতে। উনি আমাকে খুব ভালোবাসতেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, প্রাইমারিতে পড়াকালীন বার্ষিকী ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় দৌঁড়, লাফ, ঝাপ ইত্যাদিতে অংশগ্রহণ করতাম এবং পুরস্কার পেতাম। সে পুরস্কার নিয়ে বাসায় গেলে নানী ও মা খুবই খুশী হতেন। সেসময় আমি ক্রিকেট খেলতাম পাড়ার ছেলেদের সাথে। ফুটবলের প্রতি আমার কোনো আগ্রহ ছিলো না। ফুটবল খেলা শুরুর পর থেকে স্কুল, উপজেলা, জেলা, বিভাগীয় পর্যায়ে খেলেছি। তাছাড়া ভাইয়ার সহযোগিতায় ২০১৩ সালে কুষ্টিয়ায় বাফুফের প্ল্যান আনডার ফিফটিন ক্যাম্পে থাকা এবং খেলার ব্যবস্থা করে দিলেন, সবাইকে রিকোয়েস্ট করে। একমাস ক্যাম্প করলাম এবং খুলনা বিভাগের হয়ে রাজশাহীতে প্রথম একাদশ খেললাম। এতে কোচরা আমার খেলা দেখে খুশী হলেন। এরপর ভাইয়ার সহযোগিতায় ২০১৬ সালে জাতীয় টিমে খেলার সুযোগ পায়। এছাড়া মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা সহ বিভিন্ন জায়গায় আন্ডার ফোরটিন খেলেছি। সবজায়গা ভাইয়া আমার সাথে যেতেন। ভাইয়া নিজের টাকা খরচ করে আমাকে ঢাকা নিয়ে যেতেন, তার বাসায় থাকার ব্যবস্থা করতেন। তার পরিবারের সবাই আমাকে স্নেহ করতেন।
নিলা বলেন, সামাজিক কুসংস্কার-প্রতিবন্ধকতা ডিঙ্গিয়ে একমাত্র আমিই ফুটবল খেলাটা চালিয়ে গেছি। মানুষ ভাইয়াকে খারাপ ভাবতেন, কটুকথা বলতেন। আমাকে ও আমার পরিবারের লোকজনকে কটুকথা বলতেন অনেকে। মানুষের খারাপ কথা শুনে আমার সাথে যে ৫ জন ফুটবল খেলা শুরু করেছিল, তারা খেলা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু আমি খেলা বন্ধ করিনি কখনো। আজ আমি ফাত্তাহ ভাইয়ের স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছি।
প্রায় ১৮ বছর আগে আমার বাবা মাকে তালাক দেয়। এরপর আমরা আশ্রয় নিই নানীর বাড়িতে। নানী ও মামারা কখনো আমাদের বোঝা মনে করেনি। তারা সব সময় নিজের পরিবারের একজন ভেবে আমাদের আদর করতেন এবং আমাদের দেখভাল করতেন। নানি বাড়িতেই বড় হয়েছি আমি। ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ১০ লাখ টাকা দিয়ে জমি কিনি এবং এরপর বাড়ি করি।
সবসময়ের জন্য অর্থের অভাব আমাদের ছিলই। অর্থের অভাবে মন চাইলেও অনেক ইচ্ছে বা চাহিদা পূরণ হতো না। অভাব ছিল খুব। নানী, মামা এবং আম্মা আমাকে প্রচন্ড ভালোবাসেন। আমাদের দুঃসময়ে সবাই চেষ্টা করেছে আমাকে ভালো রাখার জন্য, তারা নিজেরা কষ্ট করেছে কিন্তু আমাকে কষ্ট করতে দিতে চাইনি। এখন আমার সুদিন এসেছে, এজন্য আমি চেষ্টা করি তাদেরকে ভালো রাখার জন্য। আসলে তাদেরকে ভালো রাখতেও খুব বেশি পারে না। আমি যে ভাতার টাকা পায় বাফুফে থেকে সেই টাকা আমি নিজের জন্য অল্প কিছু খরচ করি এবং বাকিটা আমি আমার মায়ের কাছে পাঠায়। বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের এত দাম যে, আমার টাকা দিয়ে সংসার চালাতে মায়ের হয়তো কষ্ট হয়ে যায়। মা নিজেও অসুস্থ, কয়েক মাস আগে অপারেশন হয়েছে একটা। আমার নানী আমাদের বাড়িতে থাকে অনেক সময়। সেও অসুস্থ নিয়মিত ওষুধ খেতে হয়।
যশোর বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বছরই ভর্তি হয়েছি। পড়াশোনা এবং খেলাধুলা নিয়েই থাকতে চাই। পড়াশুনা শেষে খেলাধুলা নিয়েই কাজ করতে চাই। আমি আমার ফ্যামিলির দেখভাল করছি। সারাজীবন আমি আমার ফ্যামিলিটাকে ঠিকমতো চালাতে চাই।
প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে গর্বিত এই ফুটবলার বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সবসময় আমাদের খোঁজখবর রাখেন। আমাদের ডেকে দেখা করেন। আমাদের ব্যাপারে সবকিছু সে জানেন। সে যেভাবে রাখবে আমি সেভাবেই থাকবো, তাতেই খুশী। আমাদের প্রতি এত স্নেহ-ভালোবাসা দেখানোর জন্য তাকে ধন্যবাদ এবং তার প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা।
কুষ্টিয়া শহরের চাঁদ সুলতানা স্কুল থেকে ২০১৮ সালে এসএসসি পাস করেন। এরপর ২০২১ সালে কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার আমলা সরকারি কলেজে থেকে এইচএসসি পাস করেন। এবছরে গত ৪ সেপ্টেম্বর খেলোয়াড় কোটায় ভর্তি হন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে।
নিলুফার বয়স যখন আড়াই বছর তখন বিচ্ছেদ হয় মা-বাবার। তার ছোট বোনের বয়স তখন মাত্র দেড় মাস। সে সময় যেন অথৈ সাগরে পড়ে যান তাদের মা বাছিরন আক্তার। কিন্তু দমে যাননি তিনি। কুষ্টিয়া শহরের থানাপাড়া এলাকায় কুঠিপাড়ার চরে মায়ের বাড়িতে ওঠেন। তিনি স্থানীয় একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চাকরি নেন। সামান্য বেতনে চলতে থাকে সংসার। এমন পরিস্থিতিতে কঠোর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দুই মেয়েকে বড় করেছেন বাছিরন। এখন সংসার চলে নিলার অর্থে।
প্রসঙ্গত, ছাত্রজীবনে অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন আহমেদ ফাত্তাহ। ঝিনাহদাহ ক্যাডেট কলেজের ছাত্র ছিলেন। কর্মস্থলেও মেধার স্বাক্ষর রাখেন। ফুটবল বিষয়ে অনেক জ্ঞান রাখতেন। এই অঞ্চলে ফিফা-এএফসির স্বীকৃত একমাত্র রিজিওনাল ইনস্ট্রাক্টর ছিলেন তিনি। ২০০৪ সালে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনে (বাফুফে) মিডিয়া ম্যানেজার হিসেবে যোগ দেন ফাতাহ। ২০১১ সাল পর্যন্ত এ দায়িত্বে ছিলেন।
এরপর বাফুফের মার্কেটিং-বিপণন বিভাগেও কাজ করেছেন। ২০১৫ সালে বাফুফের বর্তমান সভাপতি কাজী মো. সালাহউদ্দিনের ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন। ২০১৭ সালে সাইফ পাওয়ারটেকে যোগ দেন তিনি। মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত এখানেই কর্মরত ছিলেন।