ফ্রিডমবাংলানিউজ ডেস্ক | আপডেট: মঙ্গলবার, সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২১
বগুড়ার
পৌর এলাকার সুজাবাদ মোড়ে চার-পাঁচজনের
একটি দল বসে থাকে
রাস্তার পাশের টংঘরে। ট্রাক আসামাত্রই ছুটে গিয়ে সেটি
থামায়। এদের মধ্যে একজন
গিয়ে ৫০ টাকা এবং
অন্যজন গিয়ে ২০ টাকা
নেয় প্রতি ট্রাক থেকে। বিনিময়ে দুটি রসিদও পান
ট্রাকচালক। চালকেরা জানেন, এখানে তাঁদের টাকা না দিয়ে
যাওয়ার উপায় নেই। পাশের
ছোট খাবারের দোকানের কর্মচারী বলেন, ‘সারা দিন এখানে
চাঁদাবাজি হয়। পুলিশ সব
জানে।’ ট্রাক মালিক-শ্রমিকদের দুটি সংগঠন এই
চাঁদা নেয়। সংগঠন দুটি
হলো, ট্রাক মালিক-শ্রমিক সমিতি আর আন্তজেলা ট্রাক
শ্রমিক ইউনিয়ন (আবদুল মান্নান মণ্ডল)। সমিতির নেতৃত্ব
দিচ্ছেন আবদুল মান্নান আকন্দ আর ইউনিয়নের সভাপতি
আবদুল মান্নান মণ্ডল।
অনুসন্ধানে
জানা যায়, বগুড়ায় আসা
সব ট্রাককেই আটটি জায়গার কোনো
না কোনোটিতে এই চাঁদা দিতে
হয়। জায়গাগুলো হলো বেতগাড়ী বাইপাস,
সুজাবাদ, ফুলদিঘি, তিনমাথা, চারমাথা, মহাস্থান, মোকামতলা ও মাটিডালি। বগুড়া
হয়ে উত্তরাঞ্চলের ১১টি জেলায় প্রতিদিন
যাতায়াত করে প্রায় ৫
হাজার ট্রাক।
একইভাবে
প্রতিটি বাস থেকে ২০০
থেকে ৩০০ টাকা করে
চাঁদা নেওয়া হয় সাত জায়গায়।
রীতিমতো রসিদ দিয়েই এই
চাঁদা নেওয়া হয় স্থানীয়, আন্তজেলা
আর দূরপাল্লার বাসগুলো থেকে। চাঁদা না দিলে কোনো
বাস স্ট্যান্ড ছাড়তে পারে না।
সাধারণ
মানুষ, বাস-মালিক-শ্রমিকদের
সঙ্গে কথা বলে জানা
গেছে, বাসমালিকদের দুটি দল ও
শ্রমিকদের একটি সংগঠন অর্থাৎ
মোট তিনটি সংগঠন নানা স্ট্যান্ড থেকে
বাসে প্রকাশ্যে চাঁদা নিচ্ছে। শ্রমিক সংগঠন মোটর মালিক-শ্রমিক
ইউনিয়নের নেতৃত্ব দিচ্ছেন জেলা শ্রমিক লীগের
সাধারণ সম্পাদক ও পৌরসভার প্যানেল
মেয়র শামছুদ্দিন শেখ হেলাল। আর
দ্বিধাবিভক্ত সংগঠন জেলা মোটর গ্রুপের
একাংশের নেতা সংগঠনের সাধারণ
সম্পাদক আমিনুল ইসলাম ও জেলা আওয়ামী
লীগের নেতা শাহ আকতারুজ্জামান
ডিউক।। অন্য অংশের নেতৃত্বে
আছেন জেলা আওয়ামী লীগের
যুগ্ম সম্পাদক ও সংগঠনের সাবেক
আহ্বায়ক মঞ্জুরুল আলম মোহন। এই
দুপক্ষের দ্বন্দ্বে গত ১৪ এপ্রিল
খুন হন বগুড়া মিনিবাস
মালিক সমিতির সাবেক সম্পাদক ও সদর উপজেলা
বিএনপির নেতা মাহবুবুর রহমান
শাহীন। আমিনুল এই হত্যা মামলার
প্রধান আসামি।
এর
আগে চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে গত ৯
ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের দুই পক্ষে সংঘর্ষে
ছুরিকাহত হন এক পুলিশ
কর্মকর্তা। পরদিন পাঁচ শতাধিক ব্যক্তির
বিরুদ্ধে পাল্টাপাল্টি চারটি আলাদা মামলা হয়। এর মধ্যে
একটি মামলার বাদী পুলিশ, অপর
দুটির বাদী আমিনুল ইসলাম।
অন্যটির বাদী মোহনের ভাই
মশিউল আলম। পুলিশের মামলায়
মোহনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। তবে অন্য তিনটি
মামলার তদন্ত চলছে।
সরেজমিন: তিনমাথা
ও চারমাথা রেলগেট এলাকা ঘুরে দেখা গেছে
দূরপাল্লার যাত্রীবাহী বাস থেকে চাঁদা
আদায় করছে জেলা মোটর
শ্রমিক ইউনিয়ন। এই দুই এলাকায়
লোকাল বাসচালকদের কাছ থেকে ২০০-৩০০ টাকা পর্যন্ত
চাঁদা নিতে দেখা যায়।
দূরপাল্লার যেমন শ্যামলী,
শাহ ফতেহ আলী, এসআর, টিআর
প্রভৃতি বাসের চালকদের কাছ থেকে ১০০
টাকা করে চাঁদা নেয়
জেলা মোটর মালিক গ্রুপ।
দূরপাল্লার কম পরিচিত বাস
থেকেও ১০০ থেকে ৩০০
টাকা পর্যন্ত চাঁদা নেওয়া হচ্ছে। দূরপাল্লার কোচগুলোর বগুড়া ছাড়ার আগে ঠনঠনিয়া টার্মিনালে
চাঁদার টাকা কাউন্টারে পরিশোধ
করতে হয়।
চাঁদা
নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে জেলা মোটর-শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা শ্রমিক
লীগের সম্পাদক শামসুদ্দিন শেখ হেলাল বলেন,
‘প্রতিটা বাস থেকে ২০
টাকা করে নেওয়া হতো।
এই টাকা শ্রমিকদের কল্যাণেই
ব্যয় হয়।’
খোঁজ
নিয়ে জানা গেছে, বগুড়া
হয়ে দূরপাল্লা, আন্তজেলা ও অভ্যন্তরীণ রুটে
দিনে অন্তত আড়াই হাজার বাস
চলাচল করে। সে হিসাবে
বাস থেকে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের দিনে চাঁদা আদায়
হয় প্রায় সাড়ে ৭ লাখ
টাকা, যা মাসে দাঁড়ায়
সোয়া দুই কোটি টাকা।
মোটর মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘অবৈধভাবে কোনো যানবাহন থেকে
টাকা নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। সংগঠনের
নিয়মে শুধু গাড়ির খরচ
ও শ্রমিকদের জন্য কাউন্টার থেকেই
টাকা তোলা হয়।’ আর
মোটর মালিক গ্রুপের সাবেক আহ্বায়ক মঞ্জুরুল আলম মোহন বলেন,
‘আমাদের সময় কেবল ২১
টাকা করে নেওয়া হতো।
আর আমাদের গাড়ি অন্য জেলায়
ঢুকলে যে পরিমাণ চাঁদা
দিতে হতো, অন্য জেলার
গাড়ি আমাদের জেলায় ঢুকলে ঠিক সেই সমান
পরিমাণ টাকা নেওয়া হতো।
এর বাইরে আমরা কোনো টাকা
তুলতাম না।’
ট্রাকেও
চাঁদাবাজি সমানতালে: সুজাবাদ মোড়ের মতো রংপুর মহাসড়কের
ফুলদিঘি এলাকায়ও পণ্যবাহী ট্রাক থেকে নিয়মিক চাঁদা
তোলা হয়। রাত ৯টার
পর থেকে পৌরসভার বেতগাড়ী
বাইপাস এলাকায় ট্রাকে চাঁদাবাজি শুরু হয়। সেখানে
আন্তজেলা ট্রাকপরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের একটি শাখা অফিস
রয়েছে। গত শনিবার রাতে
সেখানে গিয়ে দেখা যায়,
প্রায় ১০টি ট্রাক সারিবদ্ধভাবে
দাঁড়িয়ে আছে। সব ট্রাকই
চাঁদা দিয়ে একে একে
পার হয়ে যাচ্ছে। চাঁদার
বিষয়ে জানতে চাইলে ট্রাক মালিক-শ্রমিক সমিতির সভাপতি আব্দুল মান্নান আকন্দ বলেন, ‘আমি সংগঠনের খোঁজ
রাখিনি। কারও সঙ্গে আমার
যোগাযোগ হয় না। আমি
এখন ঠিকাদারি করি।’
চাঁদাবাজিতে
পিছিয়ে নেই পুলিশও বগুড়া
শেরপুর উপজেলার চান্দাইকোনা এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে,
ট্রাক থামিয়ে টাকা নিচ্ছে হাইওয়ে
পুলিশের পাঁচ-সাতজনের একটি
দল। তারা বিভিন্ন মামলার
ভয় দেখিয়ে ১ হাজার থেকে
৩ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা
আদায় করছে বলে অভিযোগ
করেন সুলতান নামে এক ট্রাকচালক।
ট্রাকচালক-মালিকদের অভিযোগ, বগুড়ায় ট্রাক চালাতে হলে হাইওয়ে পুলিশ
থেকে ৩০০ টাকার মাসিক
টোকেন নেওয়া বাধ্যতামূলক। এ ছাড়া কাগজপত্রের
ঝামেলা কিংবা বেশি পরিমাণ পণ্য
পরিবহনের অভিযোগ তুলে যখন-তখন
চাঁদা নেয় পুলিশ।
অভিযোগের
বিষয়ে জানতে চাইলে শেরপুর হাইওয়ে পুলিশ ক্যাম্পের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বানিউল আনাম বলেন, ‘এ
বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো অভিযোগ
আসেনি, তবু বিষয়টি আমরা
খতিয়ে দেখব।’
জেলার
পুলিশ সুপার সুদীপ চক্রবর্ত্তী বলেন, ‘এ বিষয়ে খোঁজখবর
নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’