ফ্রিডম বাংলা নিউজ

শনিবার, জুলাই ৬, ২০২৪ |

EN

দেশের প্রথম স্টেশনে ট্রেন থামে না

অযত্ন-অবহেলায় দেশের প্রথম স্টেশনের বেহাল দশা

কুষ্টিয়া প্রতিনিধি | আপডেট: শুক্রবার, জুন ২৪, ২০২২

অযত্ন-অবহেলায় দেশের প্রথম স্টেশনের বেহাল দশা
প্রায় ২০০ বছর পূর্বে ব্রিটিশ শাসনামলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ও পণ্য পরিবহন কাজের জন্য ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানি বাংলাদশে প্রথম রেলপথ স্থাপন করে। প্রতিষ্ঠানটি ১৮৬২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর কলকাতা থেকে রানাঘাট এবং একই বছরের ১৫ নভেম্বর রানাঘাট থেকে কুষ্টিয়ার জগতি পর্যন্ত রেলপথ চালু করে। 

প্রতিষ্ঠার পর এই অঞ্চলের মানুষের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে জগতি স্টেশনটি। কিন্তু কালের বিবর্তনে পুরনো স্টেশনটি আজ তার জৌলুশ হারিয়ে ফেলেছে। অবহেলা, অযত্ন আর সংস্কারের অভাবে স্টেশনটি পরিত্যক্ত জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এছাড়া স্টেশনের কয়েকশ বিঘা জমি অবৈধ দখলে চলে গেছে। অযত্ন-অবহেলায় দেশের প্রথম স্টেশনের বেহাল দশা যেন দেখার কেউ নেই।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, কালের বিবর্তনে বাংলাদেশের প্রথম জগতি ট্রেন স্টেশন আজ শুধুই স্মৃতি হয়ে রয়েছে। আগের মতো ট্রেন থামে না, যাত্রীদের উপস্থিতি নেই, টিকিট কাউন্টার নেই, কোলাহলপূর্ণ পরিবেশ নেই। সেইসব এখন শুধুই স্মৃতি। কর্তৃপক্ষের অযত্ন-অবহেলায় জরাজীর্ণ হয়ে পরিত্যক্ত অঅবস্থায় রয়েছে। স্টেশনের ওয়েটিং রুম ভেঙে পড়েছে। প্লাটফর্মে ইট ও গাঁথুনি ক্ষয়ে গেছে। সংস্কারবিহীন স্টেশনের দ্বিতল ভবনের ছাদে জন্মেছে আগাছা। বিশাল আয়তনের পানির ট্যাংক দুটি পরিত্যক্ত হয়ে গেছে। বর্তমানে এখানে যাত্রীসেবামূলক কিছুই নেই। স্টেশনের অফিস রুম গুলো বন্ধ। চারদিকে বিরাজ করে নির্জন এক শুনশান পরিবেশ। স্টপেজ না থাকায় বর্তমানে এই স্টেশনের ওপর দিয়ে চলে যায় রাজশাহী-গোয়ালন্দঘাটগামী আন্তনগর ট্রেন মধুমতি এক্সপ্রেস। 

রেলওয়ে ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এখানে শুধুমাত্র স্টপেজ রয়েছে সরকারের লিজ দেয়া খুলনা-গোয়ালন্দঘাট মেইল ট্রেন নকশিকাঁথা এক্সপ্রেস এবং পোড়াদহ ও রাজবাড়ির মধ্যে চলাচলকারী শাটল ট্রেনের। এই দুটি ট্রেনের অল্পসংখ্যক যাত্রী যাতায়াত করে। স্বাধীনতার পূর্বে কুষ্টিয়ায় চিনিকল প্রতিষ্ঠার পর এখানে আখ সরবরাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল এই স্টেশনের। তখন আশপাশের জেলার জন্য ট্রেনে আনা খাদ্যশস্যসহ অন্যান্য পণ্যসামগ্রী খালাস ও যাত্রী ওঠা-নামা করত এই স্টেশনে। অথচ জগতি স্টেশনটি আজ কোলাহল মুক্ত নীরব নিথর। তবে স্টেশনে যাত্রীসেবা না থাকায় তাদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়। জনবলের অভাবও রয়েছে প্রকট। বর্তমানে এই স্টশনে দুইজন গেটম্যান রয়েছেন। অপরদিকে ২ জন স্টেশন মাস্টার, ৩ জন বুকিং সহকারী, ৩ জন ল্যামম্যান, ৩ জন পয়েন্সম্যান ও ২ জন সুইপারের পদ দীর্ঘদিন থেকে শূন্য রয়েছে।

তবে এককালে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ও পণ্য পরিবহনে এ অঞ্চলের মানুষের কাছে জগতি রেলওয়ে স্টেশনটির গুরুত্ব ও কদর ছিল যথেষ্ট। জরাজীর্ণ এই রেলস্টেশন এখন শুধুই ইতিহাস। আগামী ১৫ নভেম্বর এই রেল স্টেশনের বয়স হবে ১৬০ বছর।

স্থানীয়রা বলেন, স্টেশনে বসার জায়গা নেই, টিউবওয়েল নেই, বাথরুম নেই। একসময় কলকাতা থেকে জগতি স্টেশন হয়ে রাজবাড়ী পর্যন্ত ট্রেন চলাচল করতো। প্রতিটি ট্রেন জগতি স্টেশনে থামতো। কিন্তু এখন আগের মতো ট্রেন থামে না। দেশের অনেক রেলস্টেশনের অবকাঠামোর উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু কালের বিবর্তনে দেশের প্রথম রেলস্টেশন জগতির কোনো উন্নতি হয়নি। আগের মতো ট্রেনও এখানে থামে না। বিদ্যুৎ নেই, বাতি নেই। দিনের আলো শেষে ভুতুড়ে পরিবেশ হয়ে যায়। কোনো সুযোগ-সুবিধা পায় না যাত্রী ও দর্শনার্থীরা। এজন্য জগতি স্টেশন তার জৌলুস হারিয়েছে। ট্রেন না থামায় এবং স্টেশনটি বন্ধ থাকার জন্য এই এলাকার বাসিন্দারা পোড়াদহ ও কুষ্টিয়া কোর্ট স্টেশন ব্যবহার করে। এখানে অনেক সমস্যা। আমরা দাবি জানাচ্ছি স্টেশনটিকে আধুনিকায়ন করা হোক।

স্টেশন এলাকার বাসিন্দা বৃদ্ধা ফাতেমা খাতুন বলেন, আমার বাপ-দাদাদের সময় এই স্টেশন হয়েছিল। আমাদের জন্মের বহু আগে এই স্টেশনের জন্ম। কিন্তু দেশের প্রথম স্টেশনটি ধ্বংসের পথে। এই স্টেশনের কোনো যাত্রী সেবা নেই। মেরামতের উদ্যোগও নেয়া হয় না। দেশে ট্রেনের বিভিন্ন উন্নয়ন হয় কিন্তু জগতি স্টেশন  ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, এখানকার পরিবেশ খুবই জঘন্য। বৃষ্টি হলে দাঁড়ানোর জায়গা নাই, বসার জায়গা নাই, পানির ব্যবস্থা নাই, বাথরুমের ব্যবস্থা নাই। কর্তপক্ষের কোনো চেষ্টা নাই। তাদের চরম অবহেলায় স্টেশনটি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। সরকারের কাছে এসব সমস্যা সমাধান ও স্টেশন চালুর দাবি জানাচ্ছি। 

স্থানীয় চা দোকানদার ফরজ আলী বলেন, আমরা ছোটবেলায় দেখেছি স্টেশনটি জমজমাট। সবসময় যাত্রীদের ভিড় লেগেই থাকতো। ঘন্টায় ঘন্টায় ট্রেন থামতো। যাত্রীদের সবধরনের সুযোগ-সুবিধা ছিল। কিন্তু আজ জগতির বেহাল দশা, ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে দিনদিন। সব ট্রেন থামে না, স্টেশন বন্ধ থাকে। এই স্টেশনের অনেক সম্পদ আছে, যা হারিয়ে যাচ্ছে। এজন্য আমাদের খুব আক্ষেপ আছে, কষ্ট হয়। এ স্টেশনের ইতিহাস ধরে রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। স্টেশনটি চালু করা হলে আমাদের সুবিধা হবে। যাতায়াতের ক্ষেত্রে সময় ও খরচ কমবে।

স্থানীয় বাসিন্দা এএসএম মোস্তফা কামাল বলেন, জগতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন। কিন্তু বর্তমানে স্টেশনটির কার্যক্রম বন্ধ। দুটি ট্রেন এখানে থামে। তবে যাত্রীদের বসার ব্যবস্থা নেই, অফিস বন্ধ, যাত্রীসেবাও বন্ধ, প্রয়োজনীয় কোনো ব্যবস্থা নেই। দ্রুত স্টেশনটি চালু এবং প্রয়োজনীয় যাত্রীসেবার ব্যবস্থা করা হোক। 

জগতি রেল গেটের গেটম্যান আব্দুল রাজ্জাক বলেন, আমি গেট কিপারের দায়িত্ব পালন করি। জগতি স্টেশন বন্ধ, কোনো কার্যক্রম নেই। স্টেশনটি চালু করা হলে সবার জন্য ভালো হবে।

এবিষয়ে রেলওয়ে বিভাগের পশ্চিমাঞ্চলীয় পাকশী কার্যালয়ের বিভাগীয় প্রকৌশলী বিরবল মণ্ডল বলেন, আমাদের লোকবলের অভাব রয়েছে। নতুন করে  লোকবল বাড়ানো হলে বা প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগ দিলে স্টেশনটি চালু করা যাবে আগামীতে। দেশের প্রথম জগতি রেলওয়ে স্টেশনটি সংস্কার ও সংরক্ষণে জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে আমরা আলোচনা করি নিয়মিত। ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রতীক ওই স্টেশনটি সংরক্ষণে রেলওয়ে বিভাগ সজাগ ও যত্নবান রয়েছে।