ফ্রিডম বাংলা নিউজ

বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ২১, ২০২৪ |

EN

শেরপুরের নালিতাবাড়ী

‘খাওয়ুন লাগত না, বান্ধের একটা স্থায়ী ব্যবস্থা কইরা দেন’

গত শুক্রবার পাহাড়ি ঢলে উত্তর গড়কান্দা এলাকায় দুটি স্থানে ২০০ মিটার ও নিচপাড়া এলাকায় চারটি স্থানে ১০০ মিটার বাঁধ ভেঙে যায়।


নিজস্ব প্রতিবেদক | আপডেট: রবিবার, জুন ১৯, ২০২২

‘খাওয়ুন লাগত না, বান্ধের একটা স্থায়ী ব্যবস্থা কইরা দেন’
‘গত শুক্রবার সকালে হঠাৎ কইরাই বাড়ির সামনের বাঁধ ভাইঙ্গা যায়। আমার চোক্কের সামনে ঘরে মাচায় থাহা সাড়ে ৩০০ মণ ধানসহ ঘরটা ভাসাইয়া লইয়া গেছে গা। অহন নদীর পানি কমছে, বাড়িঘর থাইকা পানিও নাইমা গেছে। এহন পরিবারের লোকজন লইয়া নিরুপায় অইয়া বালু থাইক্কা যতটা পারি ধান কুড়াইতাছি।’

কান্নাজড়িত কণ্ঠে গতকাল শনিবার দুপুরে কথাগুলো বলছিলেন শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার খালভাঙ্গা গ্রামের কৃষক আল-আমিন (৪৮)। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘প্রতিবছর খালভাঙ্গা এলাকায় ভোগাই নদের বান্দ ভাঙ্গে, কিন্তু কেউ কোনো মেরামত করে না। রাইতে মুড়ি, চিড়া, গুড় দিছে; ওইগুলা খাইয়া কোনো রহম রাইত পার করছি। আমরা এই খাওয়ুন চাই না, পাইলে বান্ধের একটা স্থায়ী ব্যবস্থা কইরা দেন।’

এই কষ্ট শুধু কৃষক আল আমিনের একার নয়, ভারী বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে প্লাবিত উপজেলার প্রায় ৩০টি গ্রাম। সকাল থেকে ঢলের পানি নামতে শুরু করলেও দুর্ভোগ পোহাচ্ছে এসব এলাকার কয়েক হাজার মানুষ।

উপজেলা প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও ভুক্তভোগী এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, পৌর শহরের উত্তর গড়কান্দা এলাকায় ৩০০ মিটার শহর রক্ষা বাঁধ গত বছর পাহাড়ি ঢলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পৌরসভার উদ্যোগে গত সপ্তাহে উত্তর গড়কান্দা এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত ৩০ মিটার বাঁধ বালু বস্তা ফেলে মেরামত করা হয়। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার রাতে উপজেলায় মুষলধারে বৃষ্টি হয়।

পরে গত শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে পানির তোড়ে উত্তর গড়কান্দা এলাকায় দুটি স্থানে ২০০ মিটার ও নিচপাড়া এলাকায় চারটি স্থানে ১০০ মিটার ভোগাই নদের বাঁধ ভেঙে যায়। এই ভাঙন অংশ দিয়ে প্রবলবেগে পানি প্রবেশ করে উত্তর গড়কান্দা, গড়কান্দা, শিমুলতলা, নিচপাড়া, ব্যাপারীপাড়া, শিলপাড়া গ্রামের প্রায় দুই হাজার পরিবারের বাড়িঘরে পানি প্রবেশ করে।

উপজেলার বাঘবেড় ইউনিয়নের দুটি, কলসপাড় ইউনিয়নের পাঁচটি, যোগানিয়া ইউনিয়নের পাঁচটি, মরিচপুরান ইউনিয়নের পাঁচটি, নয়াবিল ইউনিয়নের তিনটি, নালিতাবাড়ী ইউনিয়নের পাঁচটি গ্রামসহ মোট ৩০টি গ্রাম প্লাবিত হয়। সকাল থেকে নদের পানি কমতে শুরু করলেও ঢলের পানিতে বাড়িঘর ও রাস্তাঘাট ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় দুর্ভোগ পোহাচ্ছে এসব গ্রামের মানুষ।

সকালে দেখা যায়, পৌর শহরের বাগানবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বারান্দায় আশ্রয় নিয়েছে উত্তর গড়কান্দা এলাকার প্রায় ১০টি পরিবার। এতে বন্ধ রয়েছে বিদ্যালয়টি। এ ছাড়া উপজেলার খালভাঙ্গা, নিচপাড়া, বাঘবেড়, যোগানিয়াসহ কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, বিভিন্ন স্থানে যাতায়াতের রাস্তা ভেঙে চলাচলে ভোগান্তি পোহাচ্ছে মানুষ।

বাগানবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় নেওয়া চাতালশ্রমিক মনোয়ারা বেগম বলেন, ‘স্বামী মইরা গেছে আট বছর আগে। একমাত্র মাইয়ারে লইয়া একটা ছোট্ট ঘরে থাকতাম। অহন ঢলের পানিতে ঘর ভাইঙ্গা গেছে। মাইয়াডারে লইয়া অহন স্কুল ঘরের বারান্দায় আছি।’

নিচপাড়া গ্রামের দিনমজুর সমেজ উদ্দীন বলেন, ‘১৫ শতাংশ জমির ওপর আমার বাড়ি আছিল। ভাঙতে ভাঙতে অহন আমার বাড়ি নদীর মধ্যে। ৬ সদস্যের পরিবার লইয়া শ্বশুরের বাড়িতে একটা ছোট্ট ঘরে থাকতাম। ওই ঘরটাও এইবার ঢলের পানিতে ভাইঙ্গা গেছে।’

এদিকে দুপুরে ডিসি সাহেলা আক্তার, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোকছেদুর রহমান, পৌরসভার মেয়র আবু বক্কর সিদ্দিক, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলামসহ সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে ভাঙন এলাকা পরিদর্শন করেছেন। এ ছাড়া গত শুক্রবার রাতেই উপজেলা প্রশাসন ও পৌরসভার পক্ষ থেকে পানিবন্দী প্রায় এক হাজার পরিবারের মধ্যে শুকনা খাবার বিতরণ করা হয়।

মেয়র আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, উত্তর গড়কান্দা এলাকায় বাঁধের ক্ষতিগ্রস্ত কিছু অংশ মেরামত করা হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ পাহাড়ি ঢলের পানিতে শহরের চারটি স্থানে ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সহযোগিতা করতে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।

ডিসি সাহেলা আক্তার বলেন, দ্রুত বাঁধ নির্মাণ ও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সহযোগিতা করতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বলা হয়েছে।

সুত্র: প্রথম আলো