দেশের দক্ষিণে অবস্থিত মেঘনা বিধৌত জেলা লক্ষ্মীপুর। দেশের ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ সয়াবিন লক্ষ্মীপুরে উৎপাদন হয়। প্রত্যাশার চেয়ে বেশি আবাদ, বাম্পার ফলন, টানা এক যুগেরও বেশি সময় ধরে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ায় ইতোমধ্যেই লক্ষ্মীপুর সয়াবিনের রাজধানী হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছে।
প্রকৃতপক্ষে সয়াবিন বাংলাদেশের জন্য একটি আর্শীবাদ। এটি বহু গুন সম্পন্ন সম্ভাবনাময় একটি ফসল। সয়াবিনে ৪০-৪৫ শতাংশ প্রোটিন এবং ১৮-২২শতাংশ তৈল বিদ্যমান। দেশে উৎপাদিত ডাল জাতীয় শস্যের তুলনায় সয়াবিন দ্বিগুন আমিষ সম্পন্ন হলেও এর দাম কম। সয়াবিনের দাম পরিমান অনুযায়ী কিছুটা বেশি নির্ধারণ করলেই অঞ্চলের কৃষকদেরকে এটি চাষে উৎসাহিত করা সম্ভব হবে। মেটানো যাবে দেশের ভোজ্য তেলের চাহিদা। এখানকার একটি উপজেলাতেই গড়ে ২০-২৫ হাজার টন সয়াবিন উৎপাদন হয়। পুরো জেলায় কয়েক হাজার টন। নদী পাড়ের প্রত্যন্ত অঞ্চল হায়দারগন্ঞ্জ এলাকায় বিপুল পরিমানে সয়াবিন উৎপাদন হলেও দেখা যায় পর্যাপ্ত দাম না পাওয়ায় অনেক কৃষক ছেড়েছেন সয়াবিন চাষ। কিন্তু এই কৃষকদের যদি ন্যায্য মূল্য দেওয়া হতো তাহলে এ অঞ্চলের সয়াবিন চাষ ৫-১০ গুন বাড়ার পাশাপাশি দেশের ভোজ্য তেলের চাহিদার বড় একটি অংশ পূরণ করা সম্ভব হতো। তবে কে শোনে কার কথা? আমদানী নির্ভর ভোজ্য তেলের যোগান যে সয়াল্যান্ডের কৃষকদের সয়াবিন চাষে অনুৎসাহিত করছে সেটি এখনো বুঝে উঠতে পারেনি সরকারসহ সংশ্লিষ্ট পক্ষ।
তাই আমাদের দেশের জাতীয় আমিষের ঘাটতি পূরন এবং দেশের অভ্যন্তরে ভোজ্য তেলের বাজার সৃষ্টির লক্ষ্যে সয়াবিন চাষে উৎসাহিত করা এবং এর ব্যবহারের বিকল্প নেই। সয়াবিন মেঘনা তীরের জেলা লক্ষ্মীপুরের অন্যতম প্রধান ফসল। মোট দেশজ সয়াবিনের উৎপাদনের সিংহভাগ-ই উৎপন্ন হয় লক্ষ্মীপুরে । লক্ষ্মীপুরের বিস্তীর্ন কৃষি জমির অধিকাংশই সয়াবিন চাষে ব্যবহুত হয়। প্রধানত রায়পুর, রামগতি ও কমলনগর উপজেলায় ব্যাপক হারে সয়াবিন চাষ হয়। সয়াবিন মূলত বেলে দোআঁশ ও লবনাক্ত মাটিতে ভালো ফলন দিতে সক্ষম । আর এ অঞ্চলের মাটি সয়াবিন চাষের বিশেষ জন্য উপযোগী। লক্ষ্মীপুর জেলার সার্বিক সয়াবিন উৎপাদনের চিত্র বিশ্লেষন করলে দেখা যায় যে, ২০০৯-২০১০ সালে এ জেলায় মোট ৩৫,৬২২ হেক্টর জমিতে সয়াবিন চাষ করা হয় এবং মোট উৎপাদন হয় ৭৬৬১০ মেট্রিক টন, ২০১০-১১ সালে মোট ৩৯,২৮৭ হেক্টর জমিতে সয়াবিন চাষ করা হয় এবং মোট উৎপাদন হয় ৭৬৬১০ মেট্রিক টন। এ সয়াবিনের বহুবিধ ব্যবহার রয়েছে। সয়াবিন থেকে সয়াডাল, সয়াছানা, সয়াদুধ, সয়াপিয়াজু, হালুয়াসহ নানাবিধ পুষ্টিকর খাবার তৈরী করা সম্ভব। যদিও সয়াবিন এখনও পোল্ট্রি খাদ্য হিসেবে জনপ্রিয় তবুও পর্যাপ্ত উদ্যোগ গ্রহন করলে এটির বহুমুখী ব্যবহার সম্ভব।সয়াবিন রোগ প্রতিরোধেও গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখে। এতে অসম্পৃক্ত ফেটি এসিড থাকায় হৃদরোগ, ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্ত চাপ রোগীদের জন্য নিরাপদ। এটি মূলত অপুষ্টিজনিক রোগে কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম। আবার সয়াপ্রোটিন ক্যান্সার প্রতিরোধেও রাখে কার্যকর ভূমিকা।
তবে যথাযথ মূল্য না পাওয়ায় ২০১০ সালের দিকে যে পরিমান সয়াবিন উৎপাদন হতো তার এ যুগ পরেও সে উৎপাদনের মাত্রা বাড়েনি এ বছর (২০২২) জেলায় ৩৮ হাজার হেক্টর জমিতে সয়াবিনের আবাদ হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭৬ হাজার ৫৪০ মেট্রিক টন। উপরন্তু এক যুগ আগের তুলনায় প্রায় ৭০ মেট্রিক টন উৎপাদন কমেছে।
লক্ষ্মীপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে হিসাব মতে , এ বছর লক্ষ্মীপুর ৫টি উপজেলায় ৩৮ হাজার হেক্টর জমিতে সয়াবিনের আবাদ করা হয়েছে। লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলায় ২ হাজার ৩শ' হেক্টর, রায়পুর উপজেলায় ৫ হাজার ৮শ' ৮৫ হেক্টর, রামগঞ্জ উপজেলায় ৫০ হেক্টর, রামগতি উপজেলায় ১৬ হাজার ৫শ' ৬৫ হেক্টর ও কমলনগর উপজেলায় ১২ হাজার ২শ' হেক্টর। যেখানে সয়াবিনের মোট উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় ৭৬ হাজার ৫৪০ মেট্রিক টন। অথচ সয়াবিনের রাজধানী খ্যাত এ জেলার কৃষকদের যদি সরকার ন্যায্যমূল্য প্রদান ও অনান্য সুযোগ-সুবিধার পরিমান বাড়াতো তাহলে এখানে উৎপাদিত সয়াবিন দিয়েই দেশের ভোজ্য তেলের চাহিদার একটি বিরাট অংশ পূরণ করা সম্ভব হতো। দেশের নিম্নআয়ের মানুষগুলোর ক্রয় ক্ষমতা বিবেচনায় ভোজ্য তেলের দাম কমাতে এমন ইতিবাচক উদ্যোগ খুলে দিতে পারে বিপুল সম্ভাবনার দ্বার।