ফ্রিডম বাংলা নিউজ

শুক্রবার, নভেম্বর ২২, ২০২৪ |

EN

আল্লাদীর মুখে এগারোর ঝড়

ফ্রিডমবাংলানিউজ ডেস্ক | আপডেট: রবিবার, সেপ্টেম্বর ৫, ২০২১

আল্লাদীর মুখে এগারোর ঝড়

দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধ, দেশভাগ, মুক্তিযুদ্ধ কত কিছুই দেখেছেন আল্লাদী বিবি। এসব নিয়ে কথা বলতে বলতে আসল ঝড়ের গল্প। আইলা-আম্পান-সিডর ফেলে তিনি শোনালেন এগারোর ঝড়ের কথা। সে নাকি শত বছর আগের ঘটনা।

 

বিশ্বাস হচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল, তাহলে আল্লাদীর বয়স কত? তিনি কি বয়সের ভারে সালের হিসাব গুলিয়ে ফেলছেন? হতে পারে; কিন্তু বিষয়টা তো একটু ঘেঁটে দেখতে হয়। তাই পরে যশোর-সাতক্ষীরা অঞ্চলের ঝড়ের রেকর্ড ঘাঁটা শুরু করলাম। আরে, ১১ সালের ঝড়ের কথা তো আছে সেখানে! ১৩১১ বঙ্গাব্দে বড় একটা সাইক্লোনের কবলে পড়েছিল সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলগুলো! বাংলা ১৩১১, অর্থাৎ ইংরেজি ১৯০৪ সাল। তার মানে এগারোর ঝড় ১১৭ বছর আগের ঘটনা।

 

আল্লাদী বিবির বয়স কত, তা বের করা এখন বেশ দুরূহ ব্যাপার। দেশে এখন প্রায় সব মানুষের জাতীয় পরিচয়পত্র আছে। আইনিভাবে সেখানে উল্লিখিত জন্মতারিখেই নিরূপণ হবে বয়স। সে অনুযায়ী তো তাঁর জন্মসাল ১৯১২। কিন্তু আল্লাদী তো বলছেন আরও আট বছর আগের কথা। আল্লাদী তাঁর স্বজনেরা বলছেন, জাতীয় পরিচয়পত্রের জন্মতারিখ আনুমানিক।

 

বয়স ঘেঁটে কিনারা করা যাবে না। তাঁর চেয়ে বরং আল্লাদীর গল্প শোনা যাক। গত শুক্রবার সকালে সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার কেরেলকাতা ইউনিয়নের উত্তর বহুড়া গ্রামে তাঁর বাড়িতে বসে কথা হচ্ছিল তাঁর সঙ্গে। তিনি স্মৃতি রোমন্থন করতে থাকেন। সুন্দরবনঘেঁষা কয়রা বেদকাশী ইউনিয়নের পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত ঘড়িলাল গ্রামে ছিল তাঁদের বাড়ি। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের (পঞ্চাশের মন্বন্তর) সময় তাঁরা চলে আসেন এই উত্তর বহুড়া গ্রামে। তিন বছরব্যাপী চলা সেই দুর্ভিক্ষে মারা গিয়েছিল তাঁর দুই ছেলে, দুই মেয়ে আর স্বামী।

 

মন্বন্তরের গল্প বলতে অনুরোধ করায় আল্লাদীর প্রশ্নকোন মন্বন্তর? বড় মন্বন্তর? বললাম, মন্বন্তরের আবার বড়-ছোট কী! পরে বুঝলাম মন্বন্তরেরও বড়-ছোট আছে। দু-বেলা দু-মুঠো খাবারের সন্ধানে প্রায় পুরোটা জীবনই যাঁরমন্বন্তরে মধ্যে কেটেছে, তাঁর কাছে তো আছেই। সেই ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি, আল্লাদী বিবি একটা ঝুড়ি আর কোদাল নিয়ে মাঠে মাঠে ঘুরছেন। হয়তো বসে আছেন কারও ধানখেতের আইলে; ধান তুলে নিয়ে গেলে সেই ধানের শিষ খুঁটবেন বা কোদাল দিয়ে খুঁড়ে ইঁদুরের গর্ত থেকে বের করে আনবেন সঞ্চিত খাদ্যশস্য।

 

আল্লাদী বিবির ছোট-ছোট ছেঁড়া-ছেঁড়া গল্পে জানা গেল, তৎকালীন দুর্ভিক্ষ এবং দেশভাগের কারণে কীভাবে নিতান্তই একটা পতিত জায়গা পরিবর্তিত হয়েছিল আজকের এই জনবহুল গ্রামে। কীভাবে দলে দলে লোক এসেছিল সুন্দরবন উপকূলীয় অঞ্চল থেকে। কীভাবে কুমারপাড়ার কুমাররা জমি বদল করে বনগাঁ চলে গিয়েছিল, আর সেখান থেকে এখানে এসে বসতি গেড়েছিল মুসলিম পরিবারগুলো।

 

আল্লাদী বিবির মন্বন্তর এখনো শেষ হয়নি। হতদরিদ্র মেয়ের কাছে আছেন আশ্রিত অবস্থায়। আশ্রয় বলতে কোনোমতে বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা বালু-সিমেন্টের মিশ্রণে তৈরি পিলারের ওপর পুরোনো ভাঙাচোরা টালির ছাউনি। রোদের আঁচ, বৃষ্টির ঝাপটা বাঁচাতে সেই ঘরের চারপাশে টাঙানো পলিথিন। বিভিন্ন রোগে ভুগলেও জুটছে না চিকিৎসাটুকু।

 

আল্লাদী বিবির মেয়ে সখিনা খাতুন বলেন, ‘অভাবের কারণে চিকিৎসা তো দূরের কথা, দু-মুঠো খাওয়াও তো দিতে পারি না।

 

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জুবায়ের হোসেন চৌধুরী বলেন, ভূমিহীন হলে আল্লাদী বিবিকে ঘর তৈরি করে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।