ফ্রিডম বাংলা নিউজ

শুক্রবার, নভেম্বর ২২, ২০২৪ |

EN

ফল সরবারহের ঝুড়ি তৈরীতে ব্যাস্ত মাহালি সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষরা

মেহেদী হাসান, ফুলবাড়ী, দিনাজপুর | আপডেট: শুক্রবার, মে ২০, ২০২২

ফল সরবারহের ঝুড়ি তৈরীতে ব্যাস্ত  মাহালি সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষরা
আমাদের দেশ ষড় ঋতুর দেশ,শুরু হয়েছে মধু মাস। মধু মাসে অন্যন্য ফলের সাথে আম ও লিচুই প্রধান ফল হিসেবে আমাদের সবার কাছে বেশ প্রিয়। দেশের লিচুর রাজ্য খ্যাত উত্তরের জেলা দিনাজপুর জেলার প্রায় সবকটি উপজেলাতেই অন্যন্য মৌসুমী ফলের পাশাপাশি গাছে গাছে ঝুলছে গোলাপী রংঙ্গের সুস্বাদু মিষ্টি রসালো ফল লিচু এবং আম।

এই মৌসুমে ফল ব্যবসায়ীরা সহ অনেকে আত্মীয় স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ফল পাঠাতে এই আম লিচু পরিবহনের জন্য অন্যতম উপকরণ হিসেবে বাঁশের তৈরী ঝুড়ি বা টুকরি ব্যবহার করে থাকে। তাই এসময় আম ও লিচুর মৌসুমে বাঁশের তৈরি ঝুড়ি (টুকরি) তৈরি করতে ব্যস্ত সময় পার করে থাকেন দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার দৌলতপুর ইউনিয়নের জয়নগর গ্রামের মাহালি সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষরা। এরা পেশায় বাঁশ শিল্পের কারিগর। দীর্ঘ দিন থেকেই এই পেশায় জড়িত মাহালি সম্প্রদায়ের লোকজন। বছরের অন্য সময় বাঁশ দিয়ে চটা চাটাই, কুলা, ডালা, চাঙারি, টুকরি, ওড়া, চালুনি, মাছ রাখার খলইসহ নানা জিনিস তৈরি করেন থাকেন তারা। তবে ফলের মৌসুমে বাঁশের তৈরি ঝুড়ি (টুকরি) তৈরি করতে ব্যস্ত সময় পার করেন এই মাহালী সপ্রদায়ের নারী-পুরুষরা।

বাজারে প্লাস্টিকের ক্যারেট আসার পর আম পরিবহনের জন্য কিছুটা চাহিদা কমলেও লিচুর জন্য এই বাঁশের ঝুড়ির বেশ কদর রয়েছে। তবে বাঁশের মূল্য বৃদ্ধি আর প্লাস্টিকের সহজ লভ্য হওয়ায় মাহালি সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী এই পেশাকে ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে তাদের।

সরেজমিনে ফুলবাড়ী উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরে ফুলবাড়ী-ঢাকা আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে জয়নগর মাহালি পাড়া গ্রাম। এই গ্রামে মাহালী সম্প্রদায়ের ৩৬টি পরিবারের বসবাস। কমবেশী সবাই বাপ-দাদার ঐতিহ্যবাহী পেশা ধরে রেখেছেন। এর মধ্যে কেউ কেউ লেখাপড়া করেএই পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় নিয়োজিত হয়েছেন।

মাহালী পাড়ায় গিয়ে দেখা মেলে, স্টেফান সরেন ও তার স্ত্রী মিনা মার্ডি, সুধীর মার্ডি ও তার স্ত্রী সোনা মনি হেমব্রম এবং সুজন মার্ডি, হেমচন্দ্র মার্ডি ও রমেশ মার্ডি তাদের বাড়ীরে উঠনে বসে মধু মাসের মৌসুমে আম-লিচু পরিবহনের জন্য টুকরি তৈরি করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। বিভিন্ন ফল ব্যবসায়ীরা তাদের চাহিদা মত ঝুড়ি কিনতে আসছেন।

কথা হয় স্টেফান সরেন এর সাথে তিনি বলেন, এবার আমের জন্য ঝুড়ি বা টুকরি চাহিদা কম থাকলেও লিচুর ঝুড়ির কিছুটা চাহিদা রয়েছে। কারণ হিসেবে স্টেফান সরেন বিষন্ন মনে বলেন, প্লাস্টিকের ক্যারেট বাজারে আসার পর থেকে অনেকেই বাঁশের টুকরি তৈরি করে নিতে চায় না।
তিনি আরও বলেন, লিচুর জন্য কিছু পাইকাড় এবং মানুষ জন আসেন তাই বর্তমানে লিচুর ঝুড়িই বানাচ্ছেন। তাছাড়া প্লাস্টিকের ক্যারেট আসার পর আম পরিবহণের জন্য ঝুড়ি নিতে চায় না অনেকেই। বেশিরভাগ লিচুর জন্য ঝুড়ি নিতে আসেন। তাছাড়া বাঁশের দাম বেশী। বাঁশ কিনে এনে ঝুড়ির জন্য প্রস্তুত করে দিনে স্বামী স্ত্রী মিলে ৪/৫টি ঝুড়ি তৈরী করা যায়। 

কথা হয় সুধীর মার্ডি ও তার স্ত্রী সোনা মনি হেমব্রম এর সাথে তারা বলেন, এক সময় প্রতিযোগীতা করে ঝুড়ি তৈরি করতাম। কিন্তু এখন সেই ব্যাস্ততা নেই। কারণ আমের জন্য প্লাস্টিকের ক্যারেট ব্যবহার করায় শুধু লিচুর ঝুড়ি তৈরি করছি। তারা স্বামী স্ত্রী দিনে ৮/১০টি ঝুড়ি তৈরি করেন। বিক্রি হয় ৬০ টাকা থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত। 

সোনা মনি হেমব্রম বলেন, ঝুড়ি তৈরির প্রধান উপকরণ বাঁশের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমাদের তেমন লাভ থাকে না। বাঁশের দাম বাড়ার কারণে ঝুড়ি তৈরির খরচ বাড়লেও বাড়েনি ঝুড়ির দাম। এখন একটি বাঁশ আমাদের কিনতে হয় ১৫০ টাকা থেকে ২০০ টাকায়। একটি বাঁশ থেকে সর্বোচ্চ ৬/৭টি ঝুড়ি তৈরি হয়। প্রতিটি লিচুর ঝুড়ি বিক্রি হয় ৮০/৯০ টাকায়। সে হিসেবে মজুরীসহ ৬/৭টি ঝুড়ি বিক্রি করে খুব বেশী লাভ হয় না। তাছাড়া ৬/৭টি ঝুড়ি তৈরিতে পরিশ্রমও কম নয়। তারপরেও পূর্বের মত ব্যবসা নেই, এখন প্লাস্টিকের সব পাওয়া যায়। বাঁশ দিয়ে তৈরি জিনিস পত্রে খাটুনি বেশী মূল্য কম। তবুও আমারা পূর্ব পুরুষদের এই পেশা ধরে রেখেছি।

ফুলবাড়ী পৌর বাজারের ফল ব্যবসায়ী গোপাল মহন্ত বলেন, বাঁশের তৈরি ঝুড়ির চাইতে প্লাস্টিকের ক্যারেটে আম ও পন্য পরিবহনে অনেক সুবিধা রয়েছে। প্লাস্টিক ক্যারেটে আম পরিবহনে আম নস্ট হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম যা বাঁশের তৈরি ঝুড়িতে অনেকটা ঝুঁকিপূর্ণ। তাছাড়ও প্লাস্টিকেরর ক্যারেট মজবুত এবং কয়েকবার ব্যবহার করা যায়, অপরদিকে বাঁশের তৈরি ঝুড়ি একবারের বেশি ব্যবহার করা যায় না। 

এদিকে এই শিল্প টিকিয়ে রাখতে সরকারের সহযোগিতার পশাপাশি আধুনিকতা ছোঁয়ায় পরিবেশ বান্ধব বাঁশে ঝুড়ি যেন হারিয়ে না যায় এবং প্লাস্টিকের ক্যারেটের পরিবর্তে বাঁশের ঝুড়ি ব্যবহারে উদ্ভুদকরণের এগিয়ে আসার দাবি করেন সুশীল সমাজ।

দৌলপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, মাহালি সম্প্রদায়ের লোকজন পারিবারিক ঐতিহ্য ও পেশা হিসেবে বাঁশ ও বেতের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। বাঁশ ও বেতের তৈরি হওয়ায় এসব পণ্য পরিবেশের জন্য উপকারী। বিভিন্ন এলাকা থেকে ফল ব্যবসায়ীরা তাদের তৈরী বাশের ঝুড়ি নিতে আসেন। আমরা সবসময় তাদের পাশে দাড়ীয়ে সহযোগিতা করার চেষ্টা করি। পরিবেশবান্ধব এই শিল্পকে ধরে রাখতে সাধ্য মত সহায়তা দেওয়া হবে।