কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আ ক ম শাহাব উদ্দিন ফরাজী হত্যার আসামিই হলেন ভারপ্রাপ্ত সভাপতি। ২০১৫ সালের ৬ অক্টোবর হত্যার শিকার হন ফরাজী।
চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলায় আসামি হয়ে কিছুদিন কারাভোগ করেছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সহসভাপতি ও বর্তমান ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ। এছাড়া বিগত নির্বাচনসহ টানা দুবার বিদ্রোহী প্রার্থী হিসাবে দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নৌকার বিরুদ্ধে ভোট করেছেন তিনি। এরপরও রহস্যজনক কারণে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরের কথা, উল্টো তাকে হত্যার শিকার সভাপতির স্থলাভিষিক্ত করে পুরস্কৃত করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
সম্প্রতি বীর মুক্তিযোদ্ধা হত্যায় অভিযুক্ত শহিদুল্লাহকে পেকুয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি করায় বেশ আলোচনা-সমালোচনা চলছে। এ ঘটনায় দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে চরম অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। অপরদিকে নিহতের পরিবারের সদস্যদের মাঝে চরম হতাশা ও ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা, প্রয়াত আ.ক.ম শাহাব উদ্দিনের ছেলে পেকুয়া উপজেলা ছাত্রলীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি মেহেদী হাসান ফরাজী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমার বাবার নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা সারা দেশে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছিল। সবকিছু জানার পরও জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা হত্যা মামলার আসামি মোহাম্মদ শহীদুল্লাহকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব দিয়ে আমার বাবার ৪০ বছরের রাজনৈতিক ইতিহাসকে কলঙ্কিত করেছেন।’
মেহেদী আরও বলেন, ‘জেলা-উপজেলার যেসব নেতারা মোহাম্মদ শহিদুল্লাহকে ফরাজীর খুনি বলে সম্বোধন করে বিভিন্ন সমাবেশে বক্তব্য দিতেন, এখন তারাই তাকে সাথে নিয়ে প্রথম সারিতে বসে সভা-সমাবেশ করছেন। এটি আমাদের পরিবারের জন্য হুমকিস্বরূপ।’
নিহত শাহাব উদ্দিন ফরাজীর স্ত্রী জেবুরুন্নেছা বলেন, ‘আমার স্বামী পেকুয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সভাপতি ছিলেন। সেই কমিটির পর কোন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়নি, এখনও সেই আগের কমিটিই আছে। সেই কমিটিতে আমার স্বামীর হত্যাকারীকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্বে বসিয়ে দিয়ে হত্যাকারীকে পুরস্কৃত করে আমাদেরকে চরম ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়েছে। ওই হত্যাকারী এখন আমাদেরকে মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়ার জন্য হুমকি দিচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার স্বামী ছাত্রলীগের রাজনীতি করেছেন, মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে বুকে ধারণ করে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন, সবশেষে এটাই কী তার প্রতিদান। এ ব্যাপারে আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে বিচার নিয়ে যাবো।’
পেকুয়া উপজেলা আওয়ামী লীগ সূত্র জানায়, ২০১২ সালের ডিসেম্বরে মুক্তিযোদ্ধা আ.ক.ম শাহাব উদ্দিন ফরাজী পেকুয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। এখনও সেই একই কমিটি বহাল আছে। বিগত ২০১৫ সালের ৬ অক্টোবর ভোররাতে নির্বাচিত সভাপতি হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
চাঞ্চল্যকর এই হত্যার ঘটনায় যথারীতি মামলাও হয়েছে। তদন্তে এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে পেকুয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সহসভাপতি একই ইউনিয়নের বাসিন্দা মাষ্টার নূরুল হকের ছেলে মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ’র সম্পৃক্ততার কথা বেরিয়ে আসে।
পুলিশ এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ওই বছরই মোহাম্মদ শহীদুল্লাহকে গ্রেপ্তার করে জেলহাজতে প্রেরণ করেন। তিনি দীর্ঘদিন জেল খেটে বেরিয়ে এসে ২০১৬ সালে টৈটং ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে নৌকার বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করেন। গেল ইউপি নির্বাচনেও তিনি নৌকার বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে ঘোড়া মার্কা নিয়ে ১৪৫ ভোট পেয়েছেন।
টৈটং ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও টৈটং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহেদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘যিনি সভাপতি ফরাজীকে হত্যা করেছেন, সেই হত্যাকারীকে আবার তার পদে বসিয়ে দেওয়াটা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের অপমানিত করার শামিল।’
কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও পেকুয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক টিমের সদস্য এস এম গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ নৌকার বিদ্রোহী প্রার্থী এবং পেকুয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা আ ক ম শাহাব উদ্দিন ফরাজীকে হত্যার আসামি। হত্যা মামলার আসামি পেকুয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করলে বাদীর পরিবার চরম হতাশায় পড়বে- এটাই স্বাভাবিক।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এডভোকেট ফরিদুল ইসলাম বলেন, ‘শহীদুল্লাহ বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে ভোট করলেও দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছেন। এ কারণে তাকে পেকুয়া উপজেলার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি করা হয়েছে।’
তৎকালীন সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহাব উদ্দিন ফরাজী হত্যার আসামি হলেও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘শহীদুল্লাহকে হত্যা মামালায় আসামি করা হলেও অভিযোগ এখনো প্রমাণিত হয়নি। তাই নিয়ম অনুযায়ী তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।’
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও চট্টগ্রাম বিভাগের সাংগঠনিক টিমের প্রধান স্বপন আহমেদ বলেন, ‘এ বিষয়ে তদন্ত করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
জানতে চাইলে ফরাজী হত্যায় জড়িত থাকার অস্বীকার করে মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ‘আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্যই পুলিশ আটক করেছিল। এর বাইরে কিছু নয়।’ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হলে কারাগারে কেন পাঠানো হয়েছিল এমন প্রশ্নের জবাবে শহীদুল্লাহ বলেন, ‘এটা আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র।’
মোহাম্মদ শহীদুল্লার দাবি, উপজেলার নেতারা সর্বসম্মতিক্রমে ও পরবর্তীতে জেলা আওয়ামী লীগের অনুমতিক্রমে তাকে পেকুয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি করা হয়েছে।
জানতে চাইলে পেকুয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘পুলিশ ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততা পেয়েছিল বলেই তাকে (শহিদুল্লাহ) আসামি করে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। শুধু জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কাউকে আটক করা হলে এবং ঘটনার সাথে সম্পৃক্ততা পাওয়া না গেলে কারাগারে পাঠানোর প্রশ্নই আসে না।