Can't found in the image content.
জেলা প্রতিনিধি | আপডেট: রবিবার, মে ১, ২০২২
সুনামগঞ্জের ফসল রক্ষা বাঁধ পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দ হওয়া সরকারি টাকায় শুরু হলেও শেষ হয় সুদ ব্যবসায়ীদের টাকায়। জেলার প্রতিটি পিআইসিতেই (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) দাদন ব্যবসায়ীদের টাকা রয়েছে। বাঁধ নির্মাণে যে টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয় তা মাঠপর্যায়ে তিন-চার ভাগে পরিশোধ করায় বিপাকে পড়তে হয় প্রতিটি পিআইসিকে। বিশেষ করে শেষ কিস্তির টাকা ছাড় করতে অনেক সময় বিলম্ব করা হয়। এজন্য তড়িঘড়ি কাজ তুলতে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটিতে টাকার জন্য ধরনা দিতে হয় এলাকার দাদন ব্যবসায়ীদের কাছে। শেষমেশ চড়া সুদে ঋণ নিয়ে অনেকটা জোড়াতালি দিয়ে বাঁধের কাজ শেষ করা হয়। এছাড়া নীতিমালায় বলা থাকলেও কখনও প্রকৃত কৃষককে দিয়ে পিআইসি গঠন করা হয় না। বেশিরভাগ কমিটি হয় রাজনৈতিক তদবিরে। অপরদিকে কাগজে-কলমে বাঁধ নির্মাণের নির্দিষ্ট তারিখ ১৫ ডিসেম্বর থাকলেও বাস্তবে কাজ শুরু করা হয় জানুয়ারিতে। দেরিতে কাজ শুরু করায় বর্ষা চলে আসে। ফলে সময়মতো নির্মাণ না হওয়ায় বাঁধ টেকসই হয় না। এভাবে প্রতিবছর জোড়াতালির বাঁধ ভেঙে ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়ে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ। সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন শনিবার যুগান্তরকে বলেন, ‘সময়মতো টাকা ছাড় করার বিষয়ে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করা হয়েছে। যথাসময়ে টাকা না দিলে গরিব কৃষকের ওপরে প্রভাব পড়ে। এতে করে কৃষকই ক্ষতিগ্রস্ত হন। আগামী মৌসুমেই বিষয়টি সংশোধন হবে আশা করছি। অপর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আসলে ১৫ ডিসেম্বর কোনো বাঁধেই কাজ শুরু করা যায় না। আবার একসঙ্গে কোথাও কাজ শুরু করতে পরি না। কারণ ওই সময় পানি থাকে। যখন যে জায়গায় পানি শুকিয়ে যায় সেখানে কাজ শুরু হয়। আসলে ইচ্ছাকৃতভাবে কাজ শুরু করতে কোনো গাফিলতি নেই।’
সুদের টাকা যেভাবে বাঁধে : পিআইসি চেয়ারম্যানদের হাতে ওয়ার্ক অর্ডার (কার্যাদেশ) দেওয়ার সময়ই বরাদ্দের ২৫ ভাগ টাকা ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে অগ্রিম পরিশোধ করার নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে। তবে বাস্তবে গত বাঁধ নির্মাণ মৌসুমে কোনো স্থানে টাকা ছাড় করা সম্ভব হয়নি। কাজ অর্ধেক শেষ হওয়ার পর দ্বিতীয় কিস্তি দেওয়ার সময় অতিবাহিত হয়ে তৃতীয় কিস্তির টাকা পরিশোধের সময় এসে যায়। টাকা পরিশোধের এই সময় শ্রমিকের পাওনা ও এক্সেভেটরের বিল পরিশোধ করতে লাখ লাখ টাকা সুদে আনতে হয় পিআইসি চেয়ারম্যানদের। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতিমাসে হাজার টাকায় দাদন ব্যবসায়ীদের দিতে হয় ১০০ টাকা। প্রতি লাখে ১০ হাজার টাকা সুদ দিয়ে টাকা নিতে হয়েছে।
এ বিষয়ে সরল স্বীকারোক্তি দেন দিরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহমুদুর রহমান মামুন। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘নিয়মানুযায়ী পিআইসিকে অগ্রিম ২৫ ভাগ টাকা দেওয়ার কথা। কিন্তু এবার টাকা দেরিতে আসায় অগ্রিম টাকাটাও দেওয়া সম্ভব হয়নি। ওই অবস্থায় টাকা জোগাড় করে প্রতিটি পিআইসিকে কাজ করতে হয়েছে।’ গরিব কৃষককে কাজ দিচ্ছি অথচ তাকে টাকা দিতে পারছি না-উল্লেখ করে মামুন দাদনের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘এই কারণে পিআইসি চেয়ারম্যানরা অন্যের সাহায্য নিচ্ছে।’ ইউএনও বলেন, ‘গতবারের কাজের সময় তিন কিস্তিতে ৬০-৬২ ভাগ টাকা দেওয়া হয়েছে। এবার দেওয়া হয়েছে ৫০-৫২ ভাগ। কোনো কোনো উপজেলায় এই বরাদ্দ ৫৪-৫৫ ভাগ হতে পারে। একটা পিআইসি কাজ শেষ করার পরও টাকা দিতে পারছি না। এটা নিজেদের কাছেই খারাপ লাগে।’ তিনি বলেন, ‘মার্চের মধ্যে যদি ৭৫ ভাগ টাকা পরিশোধ করা যায় তাহলে বাঁধে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা আদায় করা সম্ভব। একজনকে টাকাই দিতেছি ৫০ ভাগ। অথচ কাজ আদায় করতে হচ্ছে শতভাগ। যে মৌসুমে বাঁধের কাজ শুরু হয় তখন কৃষকের কাছে আসলে কোনো টাকাই থাকে না।’
ভেঙে ভেঙে বাঁধের টাকা পরিশোধের সত্যতা পাওয়া যায় পাউবোর একটি গোপন প্রতিবেদনে। এ বিষয়ে টাকা বরাদ্দের বিষয়টি উল্লেখ করে বলা হয়, সংশোধিত কাবিটা নীতিমালা ২০১৭-এর আওতায় সুনামগঞ্জ জেলার ১১টি উপজেলার বিপরীতে সর্বমোট ৬৬ কোটি ৬৩ লাখ ৬৭ হাজার টাকা প্রাথমিক বাজেটে বাদ্দ পাওয়া যায়। ইতোমধ্যে সম্পূর্ণ টাকা ছাড় করা হয়েছে। পিআইসির অনুকূলে বিল পরিশোধের নিমিত্তে প্রথম কিস্তি বাবদ ২৯ কোটি ৭৫ লাখ ৯৬ হাজার টাকা, দ্বিতীয় কিস্তি ১৯ কোটি ৫ লাখ ৪৯ হাজার টাকা এবং তৃতীয় কিস্তি ১৮ কোটি ২২ লাখ ২২ হাজার টাকা উপজেলা কমিটির সভাপতি ও সদস্য সচিবের যৌথ হিসাবে ছাড় করা হয়েছে। এমনকি ২০২০-২১ অর্থবছরে পিআইসির অনুকূলে বকেয়া চতুর্থ কিস্তির ২৬ কোটি ৮৯ লাখ ৮৬ হাজার টাকাও এবার পরিশোধ করা হয়। অর্থাৎ গত অর্থবছরের কাজের টাকা এবার পরিশোধ করা হয়।
কাজের অগ্রগতি প্রতিবেদনেও জালিয়াতি : সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলায় প্রথমে ফসল ভরা যে মাঠ তলিয়ে যায় তার স্থানীয় নাম ‘চাপটির হাওড়’। ৬ এপ্রিল পাহাড়ি ঢলের প্রথম আঘাতেই ১৬নং পিআইসির তৈরিকৃত বাঁধ ভেঙে প্রায় ৫ হাজার হেক্টর জমির ধান সম্পূর্ণভাবে তলিয়ে গেছে। পাউবোর দাপ্তরিক নথিপত্রে এই বাঁধ সংক্রান্ত যে প্রগ্রেস (অগ্রগতি) রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে তাতে বলা হয়েছে হাওড়ের অনুমোদিত ডিজাইন অনুযায়ী প্রাক্কলন প্রস্তুত করা হয়েছে। কাজের বাস্তব অগ্রগতি দেখানো হয়েছে ৯৫ ভাগ। ৫৪০ মিটার দীর্ঘ এই বাঁধ নির্মাণে বরাদ্দ দেওয়া হয় ২০ লাখ ১৮ হাজার টাকা। নথিপত্রে কাজ শুরুর তারিখ দেখা যায় ১৫ ডিসেম্বর, আর কাজ শেষ করা হয় ২৮ ফেব্রুয়ারি। অথচ সংশ্লিষ্ট পিআইসি চেয়ারম্যান জাকারিয়া চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, ‘প্রকল্প এলাকায় কাজের বিবরণ দিয়ে যে সাইনবোর্ড টানানো হয় সেখানে কাজ শুরুর তারিখ লেখা ছিল ২০২১ সালের ১৫ ডিসেম্বর। আর বাস্তবে আমাকে কাজ দেওয়া হয়েছে ২০২২ সালের ২০ জানুয়ারি। অর্থাৎ ২০ দিন পর কাজ বুঝে পেয়েও আমি ২৮ ফেব্রুয়ারির আগেই বাঁধের কাজ শেষ করেছি। এ কারণে কাজ শেষ করতে আমাকে সুদের ওপর টাকা আনতে হয়েছে।’ বিল পরিশোধের বিষয়ে জানতে চাইলে জাকারিয়া বলেন, ‘আমাকে তিন কিস্তিতে ১০ লাখ ৫৪ হাজার টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। এই টাকা থেকে জিও কার্পেটের দাম পরিশোধ করা হয়েছে নগদ ৭৫ হাজার টাকা। আরও ৫০ হাজার টাকার চেক অগ্রিম রেখে দিয়েছেন পাউবোর এসও এটিএম মোনায়েম হোসেন। চূড়ান্ত বিলে বাকি টাকা পরিশোধ করার কথা। এর মধ্যেতো আমার প্রস্তুত করা বাঁধটিই ভেঙে চাপটির হাওড় তলিয়ে গেছে।’