সেদিনের কথা মনে হলে আজও আতংঙ্কে গা শিউরে ওঠে দু'পা হারানো রেবেকা
সন্তানেরা অন্য বাচ্চাদের মতো আমার কোলে উঠতে চায়; কিন্তু আমি এমনি এক অভাগা মা! পারি না সন্তানদের আদর করে কোলে নিতে,না পারি স্বামী সন্তানের প্রয়োজনে কোন কাজে আসতে। কান্না জড়িত কন্ঠে একথা বলছিলেন ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজাধ¦সে দু'পা হারিয়ে পঙ্গত্ববরনকারী দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার রেবেকা খাতুন।
আজ ২৪ এপ্রিল ভয়াবহ রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ৯ বছরপুর্ণ হলো। আজকের এই দিনে রানা প্লাজা ধ্বসে ভয়াবহ দূর্ঘটানায় দু'পা হারিয়ে রেবেকা নানা ঘাত-প্রতিঘাত নিয়ে আজো সেই ভয়াল দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছেন। আহত মোছা. রেবেকা খাতুন দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার আলাদীপুর ইউনিয়নের বারাই চেয়ারম্যানপাড়া গ্রামের মোস্তাফিজার রহমানের স্ত্রী।
শনিবার সরজমিনে উপজেলার বারাইহাট চেয়ারম্যানপাড়া গ্রামে গিয়ে কথা হয় রানা প্লাজায় দূর্ঘটায় দু'পা হারানো পঙ্গত্ব বরণকারী সেই রেবেকা খাতুনের সাথে।
জানতে চাইলে কান্না ভরাক্রান্ত কন্ঠে রেবেকা বেগম বলেন, রানা প্লাজার কথা হয়ত এখন অনেকেই ভুলে যেতে বসেছে। কিন্তু সেদিনের সেই ভয়াবহ দুর্ঘটনার কথা আজো আমি ভুলতে পারিনি। আর কখনো পারবও না,এখনো সেদিনের কথা মনে এলে অতংঙ্কে গা শিউরে ওঠে। এই দুর্ঘটনায় আমার শরীরের অপরিহার্য্য অংশ দু'টি পা কেড়ে নিয়েছে, কেড়ে নিয়েছে আমার মা, ফুফু ও দাদীর জীবন। বিভিন্ন সুত্রে জানা গেছে,২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল আজকের এই দিনে রানা প্লাজাধ¦সের ঘটনা ঘটে,যা বিশ্বের সবচেয়ে বড় শিল্প দুর্ঘটনার একটি। সুত্র মতে এতে ১১৩৮ জন পোশাক শ্রমিকের করুণ মৃত্যু ঘটে ওই দূর্ঘনায়। আহত হন আরও দুই সহ¯্রাধিক শ্রমিক। মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনায় পুরো বিশ্ব স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিল সেদিন। ভয়াবহ সেই বিপর্যয়ের রেশ রয়ে গেছে আজও। আহতদের অনেকে এখনো আতঙ্কগ্রস্ত। এরই মাঝে বেঁচে থাকার তাগিদে নতুন পথ খুঁজে নিয়েছেন তারা; এখনো অনেকেই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন ঘুরে দাঁড়ানোর।
দু'পা হারানো আহত রেবেকা খাতুন বলেন, ঘটনার আগের দিন অর্থাৎ ২৩ এপ্রিল রানা প্লাজায় ফাটল দেখে বিকেল ৪টায় ছুটি দিয়ে দেন কর্তৃপক্ষ। পরেরদিন সকাল ৮টায় যথারিতী কাজে এসে বিল্ডিং-এর ফাটলের কারণে কাজে যোগ দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে রানা প্লাজার পক্ষ থেকে বলা হয় বেতন-ভাতাসহ অভারটামের টাকা দেয়া হবে না এবং কারো চাকুরিও থাকবে না। টাকা এবং চাকুরি হারাবার ভয়ে সব শ্রমিকের সাথে রেবেকাও কাজে যোগ দেন। সকাল ৯টায় তার মা নাস্তা খাওয়ার কথা বললে রেবেকা বলেন,একটু পরেই খাব।
এর কিছুক্ষণ পরেই ঘটে ভয়াবহ সেই দর্ঘটনা। সেই নাস্তা তো দুরের কথা রেবেকার মুখে ৩দিনেও কোনো খাবার জোটেনি। সেদিনের দূর্ঘটনায় অচেতন হয়ে ৩দিন ধরে আটকা পড়ে ছিল ওই বিল্ডিং এর ধংসাস্তুপের নিচে। পরে উদ্ধার কর্মীরা তাকে তিন দিন পর উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে। পরে নিজেকে হাসপাতালে আবিস্কার করেন তিনি। আরো পরে জানাতে পারেন তার শরীরে অপরিহার্য্য অংশ দু'টি পায়ের উরুর নিচ থেকে কেটে ফেলা হয়েছে। এরই মধ্যে তার দু'পায়ে ৮বার অপারেশন কারা হয়েছে। দীর্ঘ ১ বছর ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে কর্মহীন হয়ে গ্রামে ফিরেন রেবেকো। শুরু হয় অসহনিয় জীবন যাপন। এরই মধ্যে তার পঙ্গুত্ব জীবন জুড়ে আসে প্রথম সন্তান ছিদরাতুন মুনতাহা (৭) এবং দ্বিতীয় সন্তান মাদানী আন নুর (তিন বছর)। পঙ্গুত্বর কারণে সন্তানদের পুরো সময় দিতে পারেন না, কিন্তু ইচ্ছে করে অন্য মায়েদের মতো নিজের সন্তানদের নিয়ে ঘোরাফেরা সহ আদর করতে।
রেবেকা খাতুন বলেন, সেই সময় প্রধান মন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে যা পেয়েছি তা ভেঙ্গেই সংসার চলছে। তার স্বামী মোস্তাফিজুর রহমান তাকে সহযোগিতা করার কারনে বেশির ভাগ সময় বাড়ীতে থাকতে হয়। সে কারনে ঠিকমত কাজও করতে পারেন না। রেবেকা খাতুন সুস্থ্য হয়ে বাড়ী ফিরলে বেসরকারী কিছু সংস্থাও তাদের কিছু সহায়তা প্রদান করে । একটি বেসরকারি সংস্থা তার দু'টি কৃত্রিম পায়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন এবং একটি বাড়ি করে দিয়েছেন। কিন্তু ওই পা দিয়ে একা একা চলাচল করা সম্ভব না। কিংবা কোথাও গেলে ওই পা লাগিয়ে শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করাও কঠিন। স্বামী ছাড়া তেমন চলাফেরা বা কোন কাজ করতে পারেন না তিনি। রেবেকাকে আক্ষেপ করে রেবেকা খাতুন আরো বলেন, একজন কর্মক্ষম মানুষ এভাবে চলতে পারে না। পা হারিয়ে আজ কর্মহীন হয়ে সারা দিন বাড়ীতে বসে কাটাতে হয়।
রেবেকা খাতুনের স্বামী মো. মোন্তাফিজুর রহমান বলেন, সেই সময় চিকিৎসা জনিত কারণে ক্ষতি পূরণের জন্য যেখানে ১৫ লাখ টাকা পাওয়া কথা ছিল, সেখানে পেয়েছি ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র। বাকি ৫ লাখ টাকা পাইনি। গতবছর একটি অপরদিকে একই ঘটনায় ফুলবাড়ী উপজেলার কাজিহাল ডাঙ্গা গ্রামের মো. আতাউর রহমানের স্ত্রী ও পৌর শহরের পশ্চিম গৌরীপাড়া গ্রামের আবুল হোসেন এর কন্যা মোছা.গুলশান আক্তার সাবানাও প্রান হারায় সেদিনের দুর্ঘটনায় । তার লাশ খুঁজে পাইন তার পরিবার। নিহত সাবানার স্বামী মো. আতাউর রহমান ও ছোটো ভাই নাদিম হোসেন জানায়, গুলশান আক্তার সাবানা সেই সময় সেখানেই কাজ করতো,দুর্ঘটনার সংবাদ পেয়ে সেখানে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তার লাশ খুঁজে পায়নি। তবে নিখোঁেজর তালিকায় তার নাম থাকায় প্রধান মন্ত্রীর তহবিল থেকে ১৩ লক্ষ টাকা অনুদান পেয়েছেন। তার একটি ছেলে ও একটি মেয়ে সন্তান রয়েছে,তারা তার বাবার কাছেই থাকেন।