ফ্রিডমবাংলানিউজ ডেস্ক | আপডেট: বুধবার, সেপ্টেম্বর ১, ২০২১
নোয়াখালীর
ভাসানচর দ্বীপে আশ্রয়কেন্দ্র থেকে মাঝেমধ্যেই পালিয়ে
আসছেন রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। তাদের মধ্যে আবার বেশির ভাগই
নারী ও শিশু। ঝুঁকি
নিয়ে রাতের আঁধারে পালাতে গিয়ে ঘটছে দুর্ঘটনা।
এরই মধ্যে পুলিশের হাতে বেশ কয়েকজন
ধরা পড়েছে। আবার কক্সবাজার ক্যাম্পেও
ফিরে এসেছেন অনেকে। তবে ভাসানচর থেকে
এ পর্যন্ত কত রোহিঙ্গা পালিয়েছে
তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান
কর্তৃপক্ষের কাছে নেই।
ভাসানচরে
বর্তমানে ১৮ হাজারের বেশি
রোহিঙ্গা বসবাস করছেন। কক্সবাজারের তুলনায় উন্নত বাসস্থান আর সুযোগ-সুবিধা
নিশ্চিত করেই এই আশ্রয়কেন্দ্র
তৈরি করা হয়েছে বলে
সরকারের পক্ষ থেকে বলা
হচ্ছে। কিন্তু কক্সবাজার থেকে স্থানান্তরের পর
থেকেই দল বেঁধে ভাসানচর
ছাড়তে শুরু করেছেন রোহিঙ্গারা।
ভাসানচরে
অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের ধারণা, সেখান থেকে পালানো রোহিঙ্গার
সংখ্যা কয়েকশ। গত জুলাইয়ে সন্দ্বীপে
আটক হওয়া রোহিঙ্গা তরুণী
মিনিয়া ইমতিয়াজের সঙ্গে সম্প্রতি কথা বলা সম্ভব
হয়। তিনি বলেন, ‘আমাদের
সঙ্গে আরও ৩০-৪০
জন ছিল। তারা কক্সবাজার
পার হয়ে গেছে। বোটওয়ালা
নোয়াখালীতে নামানোর কথা বলে আমাদের
এখানে (সন্দ্বীপ) নামিয়ে চলে গেছে। আমরা
ভাসানচর থেকে নোয়াখালীতে পৌঁছে
দেওয়ার জন্য প্রতিজনে ৩০
হাজার টাকা করে দালালকে
দিয়েছি। আমাদের পরিবারের সদস্যরা কুতুপালং ক্যাম্প থেকে বিকাশে দালালদের
কাছে টাকা পাঠিয়েছিল।’
ভাসানচর
দ্বীপে উন্নত সুযোগ-সুবিধা থাকার পরও কেন পালিয়ে
আসছেন, জানতে চাইলে ওই রোহিঙ্গা তরুণী
বলেন, ‘পরিবার ছাড়া সেখানে থাকাটা
ভীষণ কষ্টের। ভাসানচরে আমাদের অনেক সমস্যা। মা-বাবা নাই। আমরা
একা ছিলাম। আমরা অনেক কষ্টে
ছিলাম সেখানে। খাওয়া দাওয়ার কষ্ট ছিল।’
কোন রুটে,
কীভাবে
পালাচ্ছেন
রোহিঙ্গারা
পালিয়ে
আসা রোহিঙ্গা এবং ভাসানচরে অবস্থানরত
রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা
যায়, মূলত স্থানীয় মাছ
ধরা ট্রলার বা ছোটখাট নৌযানে
করেই পালানোর ঘটনা ঘটছে।
কক্সবাজারে
ফেরা এক নারীর বিবরণ
অনুযায়ী, ভাসানচর থেকে প্রথমে লুকিয়ে
মাছধরা নৌকায় তাঁরা নোয়াখালী পৌঁছান। সেখান থেকে বাসে করে
চট্টগ্রাম হয়ে তাঁদের গন্তব্য
ছিল কক্সবাজার। সর্বশেষ উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। ভাসানচর থেকে এই রুটে
পালানোর সময় একাধিক গ্রুপ
এরই মধ্যে পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে।
ভাসানচর
থেকে পালিয়ে আসার পথে অসংলগ্ন
আচরণ দেখে স্থানীয় জনগণ
রোহিঙ্গাদের ধরে সন্দ্বীপ থানা-পুলিশের কাছে সোপর্দ করে।
সন্দ্বীপ
থানার ওসি বশির আহমেদ
খান জানান, এ রকম ঘটনা
প্রায় প্রতি মাসে ঘটছে। ভাসানচর
থেকে বোটে করে দালালের
মাধ্যমে তাঁরা চলে আসছেন। তাঁরা
সবাই কক্সবাজারে ক্যাম্পে ফেরত যেতে চান।
এ ছাড়া হাতিয়া, কোম্পানীগঞ্জ,
সীতাকুণ্ড, মীরসরাই বেশ কয়েকবার রোহিঙ্গাদের
আটক করা হয়েছে।
ভাসানচরে থেকে
কেন
পালাচ্ছেন
রোহিঙ্গারা
উন্নত
সুযোগ সুবিধার কথা বলা হলেও
রোহিঙ্গাদের মধ্যে এই প্রবণতা তৈরি
হলো সেটি বোঝার জন্য
ভাসানচরে অবস্থানরত কয়েজন রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলেন এই
প্রতিবেদক। এতে জানা যায়,
রোহিঙ্গাদের পাচার করতে একটি দালাল
চক্র তৈরি হয়ে গেছে।
তারা স্থানীয় মাছ ধরা নৌকার
মাঝিদের সঙ্গে যোগসাজশে রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন রুটে পালাতে সহায়তা
করছে। বিদেশে যাওয়ার লোভে অনেকে পালিয়ে
যাচ্ছে। বিদেশ নেওয়ার নাম করে অনেক
নারী-শিশুকে পাচার করে দিচ্ছে দালাল
চক্র। এ পর্যন্ত ৪
থেকে ৫ শর মতো
এভাবে ভাসান চর ছেড়েছেন। বেশির
ভাগই মালয়েশিয়া যাওয়ার উদ্দেশে আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়েছেন।
নাম
প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রোহিঙ্গা জানান,
ভাসানচর থেকে পালিয়ে যাওয়া
রোহিঙ্গাদের মধ্যে একটা অংশ আয়
রোজগার কমে যাওয়ায় হতাশ
হয়ে পড়েছেন। এ ছাড়া অনেকে
মা-বাবা পরিবার-পরিজন
কক্সবাজারে থাকার কারণে সেখানে ফিরে যেতে চাচ্ছেন।
আবার একটা শ্রেণি আছে
যারা দ্বীপের মধ্যে নিজেদের বন্দী বলে মনে করছেন।
ওই
ব্যক্তি আরও জানান, কিছু
লোক আছে মা-বাবা
ছাড়া এখানে এসেছে। কেউ আবার বেকার,
পড়াশোনা জানা কিন্তু কোনো
কাজ পাচ্ছে না। এসব কারণেই
তাঁরা হতাশ হয়ে পড়ছেন
এবং এখান থেকে পালিয়ে
যাওয়ার চেষ্টা করছেন।
ভাসানচর
থানার ওসি এবং সেখানে
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার
কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বললে তাঁরাও
রোহিঙ্গাদের পালানোর বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তবে এ পর্যন্ত
কত সংখ্যক রোহিঙ্গা পালিয়েছেন সেটি সুনির্দিষ্ট করে
কেউ বলতে পারেননি।
রোহিঙ্গারা
যেন পালাতে না পারে, সে
জন্য নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে বলে
জানিয়েছেন ভাসানচরের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা।
উল্লেখ্য,
গত ১৪ আগস্ট গভীর
রাতে ভাসানচর থেকে নৌকায় যোগে
পালিয়ে যাওয়ার সময় নৌ দুর্ঘটনা
ঘটে। এতে ২১টি শিশুসহ
৪১ জন রোহিঙ্গা ছিল।
১৩ জনকে জীবিত উদ্ধার
হয়। এ পর্যন্ত ১৫
জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এর
মধ্যে ১১টিই শিশু।
খাদ্যাভ্যাস ও
শিক্ষা
সংকট
শিশুদের
এক
রোহিঙ্গা শিশুর সঙ্গে কথা বলে জানা
যায়, তারা মিয়ানমার থাকাকালীন
কখনো কাঁকড়া খায়নি। কিন্তু এখানে এসে কাঁকড়া খেতে
মোটামুটি অভ্যস্ত হয়ে গেছে। এখান
সব খাবার খেতে পারে না।
বাধ্য হয়ে খেতে হয়।
ভাসানচরের
আরেক রোহিঙ্গা শিশু বলে, মিয়ানমার
থাকতে সে স্কুলে পড়ত।
এখানে সে এখন একটি
মক্তবে পড়াশোনা করে। ভাসানচরে প্রায়
৪ হাজার শিশু থাকলেও ১৮০টি
শিশু প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করার সুযোগ পাচ্ছে।
এদের বয়স ৫-১১
বছরের মধ্যে।
বাড়ছে অপরাধ
প্রবণতা
রোহিঙ্গা
যুবকদের কাজ দেওয়ার নাম
করে অনেকে তাদের দিয়ে অপরাধ মূলক
কর্মকাণ্ড করাচ্ছে। গত মাসে সন্দ্বীপে
এক রোহিঙ্গা যুবক আটক হয়।
তাঁর ভাষ্যমতে, তিনি এবং তাঁর
সঙ্গে আরও একজন চার
মাস যাবত সন্দ্বীপে বসবাস
করছেন। সন্দ্বীপে হাসান নামের এক যুবক তাঁদের
কাজ দেওয়ার নাম করে নিয়ে
আসে। তাদের দিয়ে ইয়াবা, গাঁজা
এবং অস্ত্র ব্যবসা করানো হচ্ছে।