দেশের ১০ জেলায় চলমান বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। উজান থেকে বানের পানি নেমে আসার পরিমাণ কয়েকদিনের তুলনায় সোমবার বেশি ছিল। ফলে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনাসহ বিভিন্ন নদীর সমতল উঁচু হচ্ছে। এতে নতুন নতুন এলাকায় ঢুকছে বন্যার পানি। এর পাশাপাশি পানি নেমে যাওয়ার প্রবণতা অব্যাহত থাকায় বিভিন্ন নদীতে ভাঙন বেড়েছে। বন্যাকবলিত জেলাগুলোতে হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি। তলিয়ে গেছে ফসলের মাঠ। অনেক জায়গায় বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে।
বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. একেএম সাইফুল ইসলাম বলেন, গত কয়েকদিন চীন, ভুটান এবং ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বৃষ্টির প্রবণতা বেশি ছিল। সেই পানি ব্রহ্মপুত্র হয়ে নেমে আসছে। এ কারণে এই বন্যা তৈরি হয়েছে। এর আগে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারে বন্যা হয়। গঙ্গা হয়ে পদ্মায় এসেছে ওই পানি। এই দুই অববাহিকার পানিই উত্তর এবং মধ্যাঞ্চলে বন্যা তৈরি করেছে। অন্যান্য বছর উত্তরাঞ্চলে বন্যার প্রকোপ বেশি থাকে। এবার পদ্মার পানির কারণে মধ্যাঞ্চলে চাপ বেশি। তবে এই অবস্থায় সর্বোচ্চ এক সপ্তাহের মধ্যে অবসান হতে পারে। কেননা, উজানে আগামী দশ দিনে মাত্র ১০০ মিলিমিটারের মতো বৃষ্টির পূর্বাভাস আছে।
সরকারের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র (এফএফডব্লিউসি) এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের (ডিডিএম) তথ্য অনুযায়ী, চলতি সপ্তাহের মধ্যে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চল থেকে নেমে যেতে পারে এই পানি। আর মধ্যাঞ্চলে তা আরও দু-একদিন বেশি স্থায়ী হতে পারে।
উত্তরের জেলা কুড়িগ্রাম থেকে মধ্যাঞ্চলের চাঁদপুর পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্র-যমুনা এবং পদ্মা পাড়ের জেলাগুলোতে বন্যা চলছে। এগুলো হচ্ছে-কুড়িগ্রাম, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, গাইবান্ধা, জামালপুর ও বগুড়া। বর্তমানে ব্রহ্মপুত্রের পানি বাড়ছে। আরও ৪৮ ঘণ্টা এই প্রবণতা অব্যাহত থাকতে পারে। এতে কুড়িগ্রাম, জামালপুরসহ সংলগ্ন জেলাগুলোতে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটতে পারে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মনু আর খোয়াই বাদে অন্য নদীর পানি কমছে। কিন্তু ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও গঙ্গা থেকে নেমে আসা পানির চাপ বাড়ছে পদ্মায়। ফলে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত আশপাশের জেলার নিুাঞ্চল আরও কয়েকদিন বন্যার পানি নিচে থাকতে পারে।
বর্তমানে দুধকুমার, ধরলা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, আত্রাই, ধলেশ্বরী, পদ্মা বিপদসীমার উপরে আছে। মেঘনায় পানি প্রবাহ অনেক। যমুনা অন্তত ৮টি পয়েন্টে বইছে বিপদসীমার উপরে। বর্তমানে বিপদসীমার সবচেয়ে উপরে আছে পদ্মা, আত্রাই ও ধলেশ্বরী। রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে পদ্মা বিপদসীমার ৪৬ সেন্টিমিটার উপরে প্রবাহিত হচ্ছে। আত্রাই বিপদসীমার ৪০ সেন্টিমিটার উপরে আছে বাঘাবাড়িতে। আর ধলেশ্বরী টাঙ্গাইলের এলাসিন পয়েন্টে বিপদসীমার ৪৫ সেন্টিমিটার উপরে আছে। কুড়িগ্রামে ধরলা আর সিরাজগঞ্জে যমুনা বিপদসীমার ৩৪ সেন্টিমিটার উপরে প্রবাহিত হচ্ছে।
সিরাজগঞ্জ : সিরাজগঞ্জের যমুনা নদীর পানি ফুঁসে উঠছে। ইতোমধ্যেই নদী তীরবর্তী পাঁচটি উপজেলার অন্তত ৩০ হাজার মানুষ বন্যাকবলিত। নদী তীরবর্তী পাঁচটি উপজেলার নদীপাড় ভাঙনে মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে জেলার দুর্গম চরাঞ্চলের মানুষ চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। যমুনায় পানি বৃদ্ধির কারণে সবজি বাগান, পাট, আখ খেত তলিয়ে গেছে। চরাঞ্চলের নিচু এলাকার মানুষ গবাদিপশু নিয়ে বিপাকে পড়েছে। সংকট দেখা দিয়েছে গো-খাদ্যের। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. আব্দুর রহিম জানান, জেলা সদর, কাজিপুর, বেলকুচি, চৌহালী ও শাহজাদপুর উপজেলার বন্যাদুর্গতদের জন্য ইতোমধ্যেই ১০০ টন চাল ও নগদ ৫ লাখ টাকা সহায়তা প্রদান শুরু হয়েছে।
নাগরপুর (টাঙ্গাইল) : নাগরপুরে বানের পানিতে ধানখেতসহ নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা করছেন কৃষকরা। কয়েক দিন ধরে উপজেলায় মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। পাশাপাশি উজানের ঢলে দেখা দিয়েছে বন্যা। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল মতিন বিশ্বাস জানান, উপজেলায় ১ হাজার হেক্টর জমিতে আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে। বন্যায় তলিয়ে গেছে ৩০ হেক্টর ধান খেত। পানি নেমে গেলে এর ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা হবে।
ভূঞাপুর (টাঙ্গাইল): ভূঞাপুরে যমুনার পানি বৃদ্ধির ফলে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে শত শত পরিবার। সপ্তাহব্যাপী এসব মানুষ পানিবন্দি হলেও সরকারি-বেসরকারিভাবে পায়নি কোনো ত্রাণ সহায়তা। এদিকে বসতঘরে পানি ওঠায় বিষাক্ত সাপের আতঙ্কে রাত পার করছেন তারা। এছাড়া বন্যার পানিতে টিউবওয়েল তলিয়ে যাওয়ায় বিশুদ্ধ খাবার পানি ও শুকনা খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে।
দেলদুয়ার (টাঙ্গাইল) : দেলদুয়ারের আটিয়া ইউনিয়নের গড়াসিন এলাকায় এলেংজানী নদীর তীরবর্তী বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে ওই এলাকার গড়াসিন, নান্দুরিয়া, নাল্লাপাড়া, গোয়ারিয়া, মৌশাকাঠালিয়া, কান্দাপাড়া ও দেলদুয়ার সদর ইউনিয়নের নিুাঞ্চলের রোপা-আমন তলিয়ে গেছে। সদর ইউনিয়নের মাদারকোল গ্রামের ২০টি বাড়ি পানির নিচে রয়েছে।
কুলাউড়া (মৌলভীবাজার) : মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার কামারচাক ইউনিয়নের করাইয়া হাওড়সহ প্রায় ১৫টি এলাকার ফসলি জমিতে পানি প্রবেশ করেছে। কৃষকরা ফসল হারানোর শঙ্কায় উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় রয়েছেন। হাওড় রক্ষা বাঁধ না থাকায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে কৃষকরা জানান। ইসলামপুর গ্রামের আতাউর রহমান সোহেল জানান, এ বছর ২০-২২ বিঘা জমিতে আমন চাষ করেছি। কিন্তু মনু ও ধলাই নদীর পানি লাঘাটা নদী দিয়ে আসায় জমির ধান তলিয়ে গেছে।