সার্বক্ষণিক ক্যামেরায় নজরদারিতে আসছে গোটা রাজধানী। উন্নত দেশের আদলে বসানো হচ্ছে উচ্চপ্রযুক্তির সিসি ক্যামেরা। ফলে অপরাধ করে পালিয়ে থাকার দিন শেষ হচ্ছে। আসামির ছবিসহ ভিডিও ধরা পড়বে সিসি ক্যামেরায়। এছাড়া সার্বক্ষণিক ভিডিও মনিটরিংয়ের আওতায় থাকবে সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানের বাসভবন। অপরাধ দমন ছাড়াও ক্যামেরা নজরদারিতে বদলে যাবে বিদ্যমান অ্যানালগ ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণব্যবস্থাও।
ঢাকা শহরের অলিগলি পর্যন্ত ক্যামেরার মাধ্যমে পর্যবেক্ষণের জন্য পুলিশ সদর দপ্তর থেকে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। ‘ঢাকার ডিজিটাল মনিটরিং সিস্টেমের উন্নয়ন’ বা ‘ডেভেলপমেন্ট অব ডিজিটাল মনিটরিং সিস্টেম অব ঢাকা প্রকল্প’-এর ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। ইতোমধ্যে প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্টাডিসহ আনুষঙ্গিক বেশকিছু কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
পুলিশের ক্যামেরা প্রকল্প সম্পর্কে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল শনিবার বিকালে যুগান্তরকে বলেন, ‘প্রকল্পটি ভালো। এটি শিগগিরই হয়তো একনেকে যাবে। পাশ হলে পরিচালক নিয়োগসহ আনুষঙ্গিক কাজ শেষে ক্যামেরা স্থাপনের কাজটিও শুরু হবে।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমানে রাজধানীর একটি ক্ষুদ্র অংশ পুলিশের সিসি ক্যামেরা মনিটরিংয়ের আওতায় রয়েছে। এজন্য প্রায় ১২শ কামেরা দিয়ে গুলশানের কূটনৈতিক জোনসহ কয়েকটি এলাকায় নজরদারি করছে পুলিশ। এছাড়া গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বেশকিছু এলাকায় সিসিটিভির মাধ্যমে নজরদারি করে। তবে এখনো রাজধানীর বেশির ভাগ এলাকা ক্যামেরা মনিটরিংয়ের আওতায় আসেনি।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গোটা রাজধানীকে সিসি ক্যামেরার আওতায় আনতে ঢাকা শহরে ১৬ হাজারেরও বেশি ক্যামেরা বসানো হবে। এর মধ্যে ১৫ হাজার ক্যামেরা শুধু অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ সংক্রান্ত কাজে ব্যবহার করবে পুলিশ। বাকি এক হাজারের মতো ক্যামেরা ব্যবহৃত হবে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার কাজে। উন্নত প্রযুক্তির ক্যামেরায় স্বয়ংক্রিয় অ্যালার্ম সিস্টেম, ফেস ডিটেকশন (চেহারা চিহ্নিতকরণ), গাড়ির নম্বর প্লেট চিহ্নিতকরণ প্রযুক্তি বা এএনপিআরসহ অন্তত ১১ ধরনের সুবিধা পাওয়া সম্ভব হবে।
প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ক্যামেরা প্রকল্পের একটি বিশেষ দিক হচ্ছে ডিজিটাল টহল নিশ্চিত করা। অর্থাৎ গভীর রাতেও নির্জন রাস্তা থাকবে পুলিশের নজরদারিতে। ক্যামেরায় চেহারা শনাক্তের প্রযুক্তি থাকায় অপরাধী এবং পলাতক আসামিদের সহজেই গ্রেফতার করা সম্ভব হবে। চুরি এবং ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ করে পার পাওয়া যাবে না।
এছাড়া থাকবে স্বয়ংক্রিয় শব্দ চিহ্নিতকরণ ব্যবস্থা। রাজধানীর কোথাও কোনো শব্দ হলে তাৎক্ষণিকভাবে শব্দের বিস্তারিত তথ্যসহ কন্ট্রলরুমে সিগন্যাল চলে যাবে। ফলে পুলিশের ভাষায় ‘শুটিং ইনসিডেন্ট’ বা গোলাগুলির ঘটনা ঘটলে দ্রুততম সময়ে তথ্য পাবে পুলিশ। এমনকি কতদূরে গুলি হয়েছে এবং কী ধরনের অস্ত্রের গুলি, তাও চিহ্নিত করা সম্ভব হবে। ক্যামেরায় থাকবে স্বয়ংক্রিয় অ্যালার্ম সিস্টেম। সন্দেহভাজন ব্যক্তি বা বস্তু ক্যামেরায় ধরা পড়ামাত্র সংকেত বেজে উঠবে।
পুলিশের ক্যামেরা প্রকল্পের সার্বিক বিষয় তদারকের দায়িত্বে আছেন পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত ডিআইজি গাজী মোজাম্মেল হক। প্রকল্পের সুবিধাগুলো তুলে ধরে তিনি বলেন, বর্তমানে ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি সার্ভিস বা ট্রিপল নাইন নাগরিকদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। ক্যামেরা প্রকল্প ট্রিপল নাইনের সঙ্গে যুক্ত হলে সেবার মান আরও বাড়বে। আক্রান্ত বা বিপদগ্রস্ত ব্যক্তি কোনোমতে ফোন তুলে একটি চিৎকার বা ‘হেল্প’ শব্দ উচ্চারণ করতে পারলেও পৌঁছে যাবে পুলিশ। কিন্তু বর্তমানে ট্রিপল নাইনে ফোন করে অভিযোগকারীকে তার নাম-ঠিকানাসহ অবস্থানের বিস্তারিত বর্ণনা দিতে হয়। কিন্তু ক্যামেরা প্রকল্প বাস্তবায়নের পর কাজটি হবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে। এজন্য নিজস্ব ভৌগোলিক লোকেশন ব্যবস্থা বা পিজিআইএস ব্যবহার করবে পুলিশ।
পুলিশের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিসি ক্যামেরা মনিটরিংয়ের মাধ্যমে বেশকিছু পুলিশিং সুবিধা মিলবে। যেমন: রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, সুউচ্চ ভবন, মেট্রোরেল, ফ্লাইওভার ও এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে থাকবে সার্বক্ষণিক নজরদারিতে। এছাড়া ইংরেজি নববর্ষ, পহেলা বৈশাখ, পূজা ও শিয়া সম্প্রদায়ের তাজিয়া মিছিলে উচ্চমাত্রায় নিরাপত্তা দিতে পারবে পুলিশ। কোনো অঘটন ঘটলে অপরাধী শনাক্ত করা আরও হবে সহজ।
ক্যামেরা প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে রাজধানীতে অ্যানালগ পদ্ধতিতে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করছে পুলিশ। ট্রাফিক সার্জেন্টদের মাধ্যমে মামলা করা হলেও আইন লঙ্ঘনের প্রবণতা কমছে না। এছাড়া প্রভাবশালীদের তদবিরের কারণে অনেক সময় ট্রাফিক সার্জেন্টদের আইন প্রয়োগ থেকে পিছু হটতে হয়।
এছাড়া একশ্রেণির পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ একেবারে কম নয়। তবে ক্যামেরা নিয়ন্ত্রিত স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিকব্যবস্থায় এসব প্রতিবন্ধকতা থাকবে না। কারণ সবকিছুই হবে একটি কেন্দ্রীয় সফটওয়্যারের মাধ্যমে। ক্যামেরায় আইন লঙ্ঘন ধরা পড়লে মামলা হবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে। মোবাইল ফোনে সংশ্লিষ্টদের কাছে মামলা সংক্রান্ত বার্তাও চলে যাবে। কারণ প্রকল্পের সঙ্গে বিআরটিএ, মোবাইল ফোন, জাতীয় পরিচয়পত্র এবং প্রাইভেট কার কলিং সিস্টেমসহ বেশ কয়েকটি তথ্যভান্ডার সংযুক্ত থাকবে। ক্যামেরা মনিটরিংয়ে পুলিশ ছাড়াও অন্য সংস্থা অ্যাকসেস নিতে পারবে। বিশেষ করে সিটি করপোরেশন, ওয়াসা এবং বিদ্যুৎ বিভাগ সেবার মান উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে।
সূত্র বলছে, অন্তত ১৫ বছর আগে রাজধানীর ৪৩টি পয়েন্টে মাত্র ১৮৫টি ক্যামেরা ছিল। পর্যবেক্ষণের জন্য আব্দুল গনি রোডে পুলিশের কমান্ড সেন্টারে একটি মনিটরিং কক্ষ খোলা হয়। পরে ক্যামেরাগুলোর মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেলেও প্রতিস্থাপন করা হয়নি। ক্যামেরা সংক্রান্ত একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ২০১০ সাল পর্যন্ত চেষ্টা করে পুলিশ। কিন্তু নানা কারণে তা হয়ে উঠেনি। পরে ২০১২ সালে তৎকালীন পুলিশ কমিশনার এবং বর্তমান আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদের উদ্যোগে রাজধানীতে একটি সিসি ক্যামেরা প্রকল্প চালু হয়। সম্পূর্ণ বেসরকারি অর্থায়নে ‘ল অ্যান্ড অর্ডার কো-অর্ডিনেশন কমিটি’ বা এলওসিসি নামের একটি ট্রাস্ট গড়ে তোলা হয়। বর্তমানে ট্রাস্টের অধীনে প্রায় ১২শ ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। গুলশানের ১০২ নম্বর রোডের ৮ নম্বর বাড়ি থেকে ক্যামেরা মনিটরিং কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এখানে একটি আধুনিক মনিটরিং সেন্টারও স্থাপন করা হয়েছে, যা সিসিটিভি মনিটরিং সেন্টার নামে পরিচিত।
গুলশান জোনের এডিসি এবং এলওসিসির ইনচার্জ রফিকুল ইসলাম বলেন, সিসি ক্যামেরা নজরদারিতে গুলশানে চাঞ্চল্যকর ইতালীয় নাগরিক তাভেল্লা সিজারির হত্যারহস্য উন্মোচন করতে সক্ষম হয় পুলিশ। এছাড়া হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার মাস্টারমাইন্ডদের শনাক্ত করা হয় সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে। ফলে গোটা রাজধানীকে সিসি ক্যামেরার আওতায় আনতে পারলে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে বড় ধরনের সফলতা পাওয়া যাবে।
সরেজমিনে গুলশানের এলওসিসি নিয়ন্ত্রণ কক্ষে দেখা যায়, দোতলা বাড়ির নিচতলার মনিটরিং কক্ষে পুলিশ সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছেন। অন্তত ৫০টি টেলিভিশন পর্দায় ক্যামেরা ফোকাস দেখানো হচ্ছে। গুলশান-বানানীর গুরুত্বপূর্ণ তল্লাশিচৌকিগুলো পুরোটাই ক্যামেরায় দেখা যাচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন ক্রসিংয়ে গাড়ি যাতায়াতের ওপর নজর রাখা হচ্ছে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে। ৪টি ক্যামেরায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে গাড়ির নম্বরপ্লেট পড়ার প্রযুক্তি বা এএনপিআর ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। এতে নির্দিষ্ট এলাকায় যাতায়াতকারী সব গাড়ির নম্বর প্লেট দেখা যাচ্ছে ক্যামেরায়।
এলওসিসি নিয়ন্ত্রণ কক্ষে দায়িত্ব পালনরত এসআই সাজ্জাদ উজ জামান বলেন, ক্যামেরা পর্যবেক্ষণের কাজটি নিঃসন্দেহে জটিল। কারণ এক্ষেত্রে কারিগরি জ্ঞানের প্রয়োজন রয়েছে। তবে দীর্ঘদিন কাজের সুবাদে এলওসিসির কাজে পারদর্শী একটি টিম দাঁড়িয়ে গেছে। যারা সর্বোচ্চ পেশাদারির সঙ্গে দায়িত্ব পালনে অভ্যস্ত।
পুলিশের ক্যামেরা প্রকল্পের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুরুতে প্রকল্পের প্রস্তাবিত ব্যয় ধরা হয় ৭ হাজার কোটি টাকা। তবে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পরামর্শে কয়েক দফা কাটছাঁট করে বর্তমানে সংশোধিত ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু এখনো প্রকল্পের কাজ আটকে আছে অর্থ বরাদ্দের জটিলতায়। মন্ত্রণালয় থেকে ক্রেডিট সাপ্লাই পদ্ধতিতে প্রকল্প বাস্তবায়নের পরামর্শ দেওয়া হলেও তাতে রাজি নয় পুলিশ সদর দপ্তর।
এছাড়া সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, মাঠপর্যায়ে ক্যামেরা স্থাপনে সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা রয়েছে। পুলিশেরই একাধিক ইউনিট নিজস্ব উদ্যোগে বিচ্ছিন্নভাবে ক্যামেরা স্থাপন করছে। এছাড়া পৃথকভাবে রাজধানীতে ক্যামেরা লাগাচ্ছে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। এতে সরকারি অর্থের বড় ধরনের অপচয় হচ্ছে বলেও মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।