দেশব্যাপী কমিটি করার ঘোষণার মধ্য দিয়ে আবারও আলোচনায় হেফাজতে ইসলাম। রাজনৈতিক অঙ্গনের অনেকেই মনে করছেন এ ঘোষণার মাধ্যমে হেফাজতে ইসলাম জানিয়ে দিলো যে, তারা নিঃশেষ হয়ে যায়নি। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে তাণ্ডব চালানোর অভিযোগে কেন্দ্রীয় নেতাদের গ্রেফতার ও গুরুত্বপূর্ণ সিনিয়র নেতাদের মৃত্যুতে বেশ কিছু দিন ধরেই নিষ্ক্রিয় ছিল হেফাজত এবং সংগঠনটি বিলুপ্ত হয়ে যাবে, এরকম গুঞ্জনও ছিল রাজনৈতিক অঙ্গনে। তবে দেশব্যাপী কমিটি দেওয়ার ঘোষণার মধ্য দিয়ে হেফাজতের একরকম পুনর্জন্ম হলো কি না, এ প্রশ্নের পাশাপাশি এর মাধ্যমে হেফাজত বড় আঘাত হানার প্রস্তুতি নিচ্ছে কি না, এ প্রশ্নও তুলছেন অনেকে।
গত বুধবার সারাদেশে জেলা, থানা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিটি করার সিদ্ধান্ত নেয় হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার জামিয়া ইসলামিয়া আজিজুল উলুম বাবুনগর মাদ্রাসায় হেফাজতে ইসলামের আমীর মাওলানা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীর সভাপতিত্বে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়। এর পাশাপাশি সভায় সংগঠনের নেতা-কর্মীদের মুক্তির বিষয়ে কোনো অগ্রগতি না হওয়ার বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা চলে এবং এ বিষয়ে আইনি সহায়তা দিতে পাঁচ সদস্যের কমিটিও করা হয়। সবকিছু মিলিয়ে সরকারের কাছে কোণঠাসা হয়ে থাকা হেফাজত যে নতুন করে সংঘটিত হওয়ার চেষ্টা করছে, এটি স্পষ্ট। আর সে কারণেই দেশব্যাপী কমিটির মধ্য দিয়ে হেফাজত আবার নিজেদেরকে পুনর্গঠিত করে, সঙ্ঘবদ্ধ করে সরকারকে আরেক দফা আঘাতের চেষ্টা চালাতে পারে বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
হেফাজতে ইসলাম কয়েক দফা সরকারের ওপর চড়াও হয়েছিল এবং সরকারকে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে ফেলারও চেষ্টা করেছিল। ২০১৩ সালের ৫ মে তারা প্রথম দফায় চেষ্টা করেছিল। সে সময় গণজাগরণ মঞ্চের বিরোধিতা করে হেফাজত ঢাকা চলো কর্মসূচি দিয়েছিল এবং ঢাকায় এসে অবস্থান গ্রহণ করেছিল। তাদের ভেতরের খবর ছিল যে, সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত অবস্থান কর্মসূচি রাখবে। পরবর্তীতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপড়তায় তাদেরকে শাপলা চত্বর থেকে সরিয়ে দেয়া সম্ভব হয়েছিল। সেই সময়ে প্রয়াত জুনায়েদ বাবুনগরী সরকার উৎখাতের সুস্পষ্ট ডাক দিয়েছিলেন এবং ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমের ঘোষণা দিয়েছিলেন। যদিও সেই ঘোষণা শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। তারপর সরকার হেফাজতের সঙ্গে এক ধরনের সমঝোতা করে এবং এ সমঝোতার মাধ্যমে হেফাজতে ইসলাম পুনর্গঠিত হয়, শক্তি সঞ্চয় করে এবং পরবর্তীতে সরকারের মাথাব্যথার কারণে পরিণত হয়। তখন হেফাজত এমন একটি শক্তিতে পরিণত হয়েছিল যে, সরকারের চোখে চোখ রেখে কথা বলছিল এবং বিভিন্ন ইস্যুতে তারা সরকার কি করবে না করবে সে ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছিল। এই ধারাবাহিকতায় জুনায়েদ বাবুনগরী হেফাজতের আমীর হন এবং তারপর থেকেই তিনি সরকারবিরোধী একটি অবস্থান সুস্পষ্ট করে দেন।
জুনায়েদ বাবুনগরী আমীর হওয়ার পর থেকেই ভাস্কর্য ইস্যু, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর ইস্যুতে হেফাজত পুরোপুরিভাবে সরকারবিরোধী অবস্থানে চলে যায় এবং সরকার পতনের ষড়যন্ত্রও চলে। পরে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে মামুনুল হকসহ বেশ কয়েকজন হেফাজত নেতার গ্রেফতারের পাশাপাশি সিনিয়র নেতাদের মৃত্যুর কারণে অনেকখানি দমে যায় হেফাজত। বিশেষ করে হেফাজতের সাবেক যুগ্ম-মহাসচিব মামুনুল হকের নারী কেলেংঙ্কারিতে সংগঠনটির নেতাদের বিরুদ্ধে নীতি-নৈতিকতা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন ওঠে। এছাড়া মামুনুল হকের বিরুদ্ধে বলাৎকারের অভিযোগও উঠে। পাশাপাশি হেফাজতে ইসলামের আদর্শ বিচ্যুত হয়েছে, মওদুদীর সালাফিবাদের চর্চা করছে এবং দেশের শান্তি শৃঙ্খলা এবং স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে- এমন সব অভিযোগ তুলে হেফাজতের নায়েবে আমীর মাওলানা আবদুল্লাহ মোহাম্মাদ হাসানসহ অনেকেই গণহারে পদত্যাগ করেছিলেন। জুনায়েদ বাবুনগরী হেফাজতের আমীর থাকা অবস্থাতেই হেফাজতের বেশ কয়েকজন নেতা যারা বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করে সরকার। ফলে নতুন করে ইউনিয়ন পর্যায় থেকে শুরু করে দেশের থানা ও জেলা পর্যায়ে কমিটি করার মাধ্যমে হেফাজত যে সরকারকে বড় রকমের আঘাত করবে না, এ গ্যারান্টি কেউ দিতে পারবে না।
২০১৩ এবং ২০২১ সালে স্পষ্টতই হেফাজত সরকার পতনের চেষ্টা করেছিল এবং নেপথ্যে ছিল বিএনপি-জামায়াত। এখন যখন হেফাজত আবার নতুন করে দেশব্যাপী কমিটি করছে তখন আবার প্রশ্ন উঠেছে যে, হেফাজত পুনরুজ্জীবন মানেই মৌলবাদী, স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির বিজয়। হেফাজতের পুনরুজ্জীবন মানেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের শক্তির জন্য একটি চিন্তার কারণ। কারণ হেফাজত যখনই সংঘটিত হয়, যখনই শক্তিশালী হয়, তখনই তারা আক্রমণ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকারকে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মানুষকে। আর তাই এখন যখন সারাদেশে কমিটি করতে যাচ্ছে হেফাজত তখন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, হেফাজত আবার সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে এবং এই সংঘটিত হওয়ার মাধ্যমে ভবিষ্যতে হয়তো শক্তি সঞ্চয় করে তারা সরকারকে নতুন করে আঘাত করবে।