সম্প্রতি হাইকোর্টে জমা দেওয়া দুদকের একটি অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে। রাজারবাগ দরবার শরিফ ও দিল্লুর রহমানের সম্পদ-দায় বিষয়ে তদন্ত করতে গত বছরের সেপ্টেম্বরে দুদককে নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। এ নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত করে হাইকোর্টে অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন দিয়েছে দুদক।
দুদকের অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বান্দরবানের লামায় ৩০০ একর রাবারবাগান ৪০ বছরের জন্য ইজারা নিয়েছেন দিল্লুর রহমান। এ ছাড়া তাঁর মালিকানায় ৫৬টি গাড়ি আছে।
দিল্লুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ—তিনি ধর্মের নামে সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দিচ্ছেন। অনিয়মের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন এলাকায় সাত হাজার একর জমি কিনেছেন। বেআইনিভাবে রাবারবাগান দখল করেছেন। তিনি বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন।
অভিযোগগুলো যাচাই-বাছাই শেষে অনুসন্ধানে নামে দুদক। দিল্লুর রহমান লিখিত জবাবে দুদককে বলেছেন, তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অসত্য।
দুদকের উপপরিচালক (মিডিয়া) আরিফ সাদেক বলেন, হাইকোর্টে অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জমা দিতে আদালতের কাছে আরও তিন মাস সময় চাওয়া হয়েছে।
দুদকের একটি সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সংস্থার উপপরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলমের নেতৃত্বে সহকারী পরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম ও মো. আলতাফ হোসেন এ বিষয়ে অনুসন্ধান করেছেন। অনুসন্ধানের আলোকে আদালতে একটি অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। আরও কিছু কাজ বাকি আছে। সে জন্যই আদালতের কাছে সময় চাওয়া হয়েছে।
অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদনে দুদক বলেছে, দেশের ৩১ জেলায় মোট ৫৫ দশমিক ১৪ বিঘা জমির সন্ধান পাওয়া গেছে।
বান্দরবান জেলা প্রশাসকের কার্যালয় জানিয়েছে, ১২টি লিজ মামলার মাধ্যমে মুহাম্মদিয়া জামিয়া শরিফ মাদ্রাসার নামে লামা উপজেলায় ৩০ হাজার শতক বা ৩০০ একর জমি (রাবারবাগান) লিজ দেওয়া হয়েছে। বাগানগুলো ৭৫ হাজার টাকা করে মোট ৯ লাখ টাকায় দরবার শরিফ ইজারা নিয়েছে।
সরকারি নিরীক্ষা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে কক্সবাজার, কুমিল্লা, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, গাজীপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জামালপুর, জয়পুরহাট, দিনাজপুর, নওগাঁ, নীলফামারী, নেত্রকোনা, নরসিংদী, পাবনা, পঞ্চগড়, পিরোজপুর, বগুড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, বরগুনা, ভোলা, মানিকগঞ্জ, মৌলভীবাজার, রংপুর, লক্ষ্মীপুর, লালমনিরহাট, শেরপুর, সিরাজগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও খাগড়াছড়ির বিভিন্ন মৌজায় রাজারবাগ দরবার শরিফের জমির ৯০টি দানপত্র দলিল পেয়েছে দুদক।
দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়, দানের এ জমির পরিমাণ ৩৫ দশমিক ৭৫ বিঘা। এর বাইরে দরবার শরিফের নামে কেনা জমির পরিমাণ ১৯ দশমিক ৩৯ বিঘা।
৫৫ দশমিক ১৪ বিঘা জমির মধ্যে বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় ১৩ দশমিক ৩২ বিঘা জমির ওপর ৪০টি মসজিদ ও মাদ্রাসা ধর্মীয় কাজে নিয়োজিত আছে বলে দুদকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
২০২১-২২ অর্থবছরে দিল্লুর রহমান যে আয়কর রিটার্ন জমা দিয়েছেন, সে হিসাবে তাঁর মোট সম্পদের পরিমাণ ৪৯ লাখ ৭২ হাজার ১১৯ টাকা। এর মধ্যে জেড আর এস্টেটের (প্রা.লি) ৫৪টি শেয়ারের মূল্য ৩৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা। অলংকারের মূল্য ৮ লাখ ৬ হাজার ১১৯ টাকা। আসবাবপত্রের মূল্য ৮৪ হাজার টাকা। বৈদ্যুতিক সামগ্রীর মূল্য ৮২ হাজার টাকা। হাতে নগদ অর্থ রয়েছে দেড় লাখ টাকা।
দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকার ৫ নম্বর আউটার সার্কুলার রোডে দিল্লুর রহমানদের জমির পরিমাণ দুই বিঘার ওপর। কাগজপত্রে এ জমির মালিক দিল্লুর রহমানের ভাই হাফিজুর রহমান। ১৯৯১ সালে তাঁরা জেড আর এস্টেট প্রাইভেট লিমিটেড গঠন করেন। জমিটি লিমিটেড কোম্পানির হিসেবে দেখানো হয়। এ কোম্পানিতে দিল্লুর রহমানের শেয়ার আছে। জমির ওপর তিনটি ভবন আছে।
আয়কর বিভাগে গত বছরের ৩০ জুন রাজারবাগ দরবার শরিফের দাখিল করা অডিট রিপোর্ট অনুযায়ী, দরবার শরিফের ৫৬টি অতি পুরোনো মডেলের পিকআপ ভ্যান বা কাভার্ড ভ্যান রয়েছে। এর দাম দেখানো হয়েছে ২৫ লাখ ৬৪ হাজার ৭১৩ টাকা।
এর বাইরে রাজারবাগ দরবার শরিফের অধীন মুহাম্মদিয়া জামিয়া শরিফ মাদ্রাসা ও এতিমখানা রয়েছে। সেখানে শিশুশ্রেণি থেকে কামেল শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়ার ব্যবস্থা আছে। সারা দেশেই এ মাদ্রাসার কিছু কাজ চলমান।
রাজারবাগ দরবার শরিফ থেকে ‘আল বাইয়্যেনাত’ নামে একটি মাসিক ও ‘আল ইহসান’ নামের একটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। রাজারবাগ দরবার শরিফের মুহাম্মদিয়া গবেষণাকেন্দ্র, ক্যানটিন, মুদিখানা, আল মুতমাইন্নাহ মা ও শিশু হাসপাতাল ও সুন্নতি জামে মসজিদ আছে।
দুদকের কর্মকর্তারা বলছেন, দিল্লুর রহমানের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ প্রমাণে তাঁর আয়কর রিটার্নের নথি, রাজারবাগ দরবার শরিফের আয়কর রিটার্ন ও অডিট প্রতিবেদনের অনুলিপি, জেলা রেজিস্ট্রারের কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্য, বান্দরবান জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করা হয়।
দিল্লুর রহমানসহ তাঁর স্ত্রী-সন্তান ও মুহাম্মদিয়া জামিয়া শরিফ মাদ্রাসার নামে ১৯৯০ সাল থেকে কোনো জমি রেজিস্ট্রেশন হয়েছে কি না, সে সম্পর্কে তথ্য সরবরাহের জন্য ৬৪ জেলার জেলা রেজিস্ট্রারদের কাছে চিঠি পাঠায় দুদক।
দিল্লুর রহমান, তাঁর পরিবার বা তাঁর প্রতিষ্ঠানের নামে কোনো চলতি হিসাব/সঞ্চয়ী হিসাব খুলে লেনদেন করা হয়েছে কি না, সে সম্পর্কে তথ্য সরবরাহের জন্য ৫৬টি তফসিলি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদেরও চিঠি দেয় দুদক।
গাড়ির তথ্য পেতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষকে দুদক চিঠি দেয়।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর, জাতীয় ডাক বিভাগ, জীবনবিমা করপোরেশন, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, রিহ্যাব, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কাছ থেকেও তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা চালায় দুদক।
এখনো সব প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে দুদক তথ্য হাতে পায়নি বলে জানিয়েছে।
রাজারবাগ দরবার শরিফের পীর ও তাঁর ১১ সহযোগী দেশের ৬ জেলায় পৃথক ৩৪টি মামলা দিয়ে হয়রানি করছেন অভিযোগ করে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা চেয়ে ৮ ব্যক্তি গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বরে হাইকোর্টে রিট করেন, যাঁর ওপর শুনানি নিয়ে রুলসহ আদেশ দেন আদালত। এর আগে ৪৯ মামলার চক্করে পড়ে একরামুল আহসান নামের ৫৫ বছর বয়সী এক ব্যক্তি হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন।
সুত্র: প্রথম আলো