মাসে ১০ হাজার টাকা বেতনে রাজধানীর ইন্দিরা রোড এলাকার একটি আবাসিক ভবনে দারোয়ানের চাকরি করেন আবুল হাসিম। স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে কাছেই টিনের এক কক্ষের একটি ঘরে থাকেন তিনি। ভাড়া পাঁচ হাজার টাকা। গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে তিনি খবর পান, ইন্দিরা রোডের কাছে খামারবাড়ি এলাকায় টিসিবির পণ্যবাহী ট্রাক এসেছে। তেল, ডাল, চিনি, পেঁয়াজ, ছোলা ও খেজুর—এই ছয় পণ্য নির্ধারিত পরিমাণে একসঙ্গে ‘প্যাকেজ’ আকারে বিক্রি হচ্ছে। দাম ৯৭০ টাকা।
মাসের শেষ দিকে আবুল হাসিমের হাতে বলতে গেলে টাকা থাকেই না। গতকাল তাঁর পকেটে ছিল ৪৫০ টাকা। বেতন পেলেই শোধ করে দেবেন—এমন আশ্বাস দিয়েও পরিচিত কয়েকজনের কাছে টাকা ধার চেয়েও পাননি তিনি। যে ভবনে দিনের বেলায় দারোয়ান হিসেবে কাজ করেন, মন খারাপ করে সেখানেই তিনি বসে ছিলেন। কিছুক্ষণ পর ওপরের একটি ফ্ল্যাট থেকে ডাক আসে তাঁর। তাঁকে বাজার এনে দিতে বলেন ওই ফ্ল্যাটের গৃহিণী। এই সুযোগে ওই নারীর কাছে নিজের আর্থিক অসংগতির কথা জানান। তখন তাঁকে ৫০০ টাকা ধার দেন তিনি।
নিজের পকেটে থাকা ৪৫০ টাকা এবং ধার করা ৫০০ টাকা—সব মিলিয়ে ৯৫০ টাকা। তাঁর প্রয়োজন ছিল আরও ২০ টাকা। পরে পাড়ার পরিচিত এক মুদিদোকানির কাছ থেকে ৫০ টাকা নিয়ে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে টিসিবির পণ্য বিক্রির লাইনে দাঁড়ান তিনি। প্রায় দুই ঘণ্টা পর আড়াইটার দিকে সুযোগ পান পণ্য কেনার।
আবুল হাসিম বলেন, গরিবের তেল, ডাল, চিনি, পেঁয়াজ হলেই হয়। এখন ছোলা-খেজুরও দিচ্ছে। সব মিলিয়ে ৯৭০ টাকা লাগে। প্রয়োজন না থাকলেও দুই কেজি খেজুর ও চার কেজি ছোলা কিনতে হলো। কিন্তু এত টাকা তো গরিবের হাতে থাকে না।
খামারবাড়িতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকে করে গতকাল পণ্য বিক্রি করেন টিসিবির পরিবেশক মেসার্স সদাই জেনারেল স্টোরের বিক্রয় প্রতিনিধিরা। একজন ক্রেতার কাছে ‘প্যাকেজ’ পদ্ধতিতে ২২০ টাকায় দুই লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল, ১৩০ টাকায় দুই কেজি মসুর ডাল (মোটা দানা), ১১০ টাকায় দুই কেজি চিনি, ১৫০ টাকায় পাঁচ কেজি পেঁয়াজ, ২০০ টাকায় চার কেজি ছোলা ও ১৬০ টাকায় দুই কেজি খেজুর বিক্রি করা হয়েছে। এই ছয়টি পণ্যের প্যাকেজ কিনতে একজন ক্রেতাকে ৯৭০ টাকা ব্যয় করতে হয়েছে।
এর আগে টিসিবির ট্রাকে শুধু সয়াবিন তেল, মসুর ডাল, চিনি ও পেঁয়াজ বিক্রি করা হতো। এই চার পণ্যের প্যাকেজ কিনতে তখন একজন ক্রেতার খরচ হতো ৬১০ টাকা।
খামারবাড়িতে গতকাল পণ্য কিনতে আসা গৃহকর্মী মোসাম্মত বেগমের অবস্থা ছিল আবুল হাসিমের চেয়েও করুণ। তাঁর কাছে ছিল মাত্র ৩০ টাকা। যে বাসায় তিনি কাজ করেন, ওই বাসার গৃহিণীর কাছ থেকে এক হাজার টাকা ধার করে টিসিবির লাইনে দাঁড়াতে হয় তাঁকে। দুপুর ১২টার দিকে লাইনে এসে দাঁড়ান তিনি। পণ্য কেনার সুযোগ পান বেলা দুইটার পর। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, চার কেজি ছোলা ও দুই কেজি খেজুরের টাকায় চাল, লবণ ও অন্য জিনিস কেনা দরকার ছিল তাঁর।
গত সোমবার (২১ মার্চ) টিসিবির ট্রাকে ছোলা বিক্রি শুরু হয়। নির্দেশনা ছিল, একেকজন ক্রেতার কাছে সর্বোচ্চ চার কেজি করে ছোলা বিক্রি করা যাবে। খেজুর বিক্রি শুরু হয় এর পরদিন থেকে, একজন ক্রেতার কাছে সর্বোচ্চ এক কেজি করে।
টিসিবির মুখপাত্র হুমায়ূন কবির বলেন, কোনো পরিবেশক বা তাঁর প্রতিনিধিরা যদি জোর করে ক্রেতাদের কাছে বেশি পরিমাণে ছোলা ও খেজুর প্যাকেজ করে বিক্রি করেন, সেটা অন্যায়। বিক্রির স্থান থেকে তাৎক্ষণিক কেউ জানালে ওই পরিবেশকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গতকাল খামারবাড়িতে টিসিবির পরিবেশক সদাই জেনারেল স্টোরের বিক্রয় প্রতিনিধিরা প্রত্যেক ক্রেতার কাছে দুই কেজি করে খেজুর বিক্রি করেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে টিসিবির পরিবেশকের বিক্রয় প্রতিনিধি দেলোয়ার হোসেন দাবি করেন, ক্রেতাদের আগ্রহের কারণেই দুই কেজি করে বিক্রি করা হচ্ছে। এ নিয়ে তিনি আর কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
টিসিবি সূত্র বলছে, প্রথমে চার কেজি করে ছোলা বিক্রির নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। সেটা পরিবর্তন করে দুই কেজি করা হয়েছে। প্রত্যেক পরিবেশককে এ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া খেজুর বিক্রি করতে হবে এক কেজি করে।
তবে এভাবে প্যাকেজ আকারে বিক্রির বিষয়টি বাস্তবসম্মত নয় বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ে (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এখন নিম্ন আয়ের মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যই বেশি দরকার। এমন অনেক মানুষ আছেন, যাঁদের কাছে ছোলা বা খেজুর এখন বিলাসী খাদ্যদ্রব্য। এই দুই পণ্য যুক্ত করার ফলে প্যাকেজটা অনেক মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেল।
আগের প্যাকেজের পাশাপাশি ছোলা ও খেজুর আলাদা করে বিক্রির পরামর্শ দেন সেলিম রায়হান। তিনি বলেন, এমনভাবে টিসিবির পণ্য বিক্রি করা উচিত, যাতে যার যেটা প্রয়োজন, সে যেন তা কিনতে পারে।
আগের দামেই ভোজ্যতেল
সরকার গত রোববার প্রতি লিটারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ১৬৮ থেকে ৮ টাকা কমিয়ে ১৬০ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে। প্রতি পাঁচ লিটার সয়াবিন তেলের বোতলের দাম ৩৫ টাকা (লিটারে সাত টাকা) কমিয়ে ৭৬০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। খোলা সয়াবিনের ক্ষেত্রে লিটারে সাত টাকা কমিয়ে নতুন দাম ঠিক করা হয়েছে ১৩৬ টাকা।
তবে সরকার নির্ধারিত দামে এখনো বাজারে সয়াবিন তেল বিক্রি শুরু হয়নি। দোকানিরা বলছেন, কোম্পানিগুলো নতুন দরে ভোজ্যতেল এখনো বাজারজাত শুরু করেনি।
রাজধানীর তেজকুনিপাড়ার রেলওয়ে মার্কেটের মাইনুদ্দিন জেনারেল স্টোরে গতকাল প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৬৮ টাকায় বিক্রি করা হয়। পাশের আবদুর রহিম জেনারেল স্টোরে খোলা সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১৬০ টাকায় বিক্রি করা হয়, যা সরকারি নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে ২৪ টাকা বেশি।
দোকানি আবদুর রহিম বলেন, সরকারের দাম কমানোর ঘোষণা দেওয়ার এক দিন আগে এই তেল কেনা হয়েছে। তাই আগের দামেই বিক্রি করা হচ্ছে।
সুত্র: প্রথম আলো