রাজধানীর শাহবাগে অবস্থিত গণগ্রন্থাগার আধুনিক রূপে সাজতে যাচ্ছে। যেখানে উন্নত বিশ্বের পাঠাগারের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকবে। ‘গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের বহুতল ভবন নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় নতুন এই গণগ্রন্থাগারে দিনের বেলা পর্যাপ্ত সূর্যের আলো থাকলে বৈদ্যুতিক বাতির প্রয়োজন হবে না। সেখানে থাকবে শিশু, প্রতিবন্ধী, বয়স্ক নাগরিকদের জন্য আলাদাভাবে বই পড়ার ব্যবস্থা। গবেষণার জন্য রাখা হচ্ছে বিশেষ স্থান ও পরিবেশ। ডিজিটাল লাইব্রেরির সুব্যবস্থা ছাড়াও থাকবে বিশ্বের নামিদামি গুরুত্বপূর্ণ সব লাইব্রেরিতে ডিজিটালি প্রবেশ ও বই পড়ার সুযোগ-সুবিধা। গবেষণা, বই পড়া, সুস্থ সাংস্কৃতিক আয়োজন-সব মিলিয়ে বইকে ঘিরে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে একটি বিশেষ জায়গা হিসাবে তৈরি করা হবে গণগ্রন্থাগারের নতুন ভবনকে।
গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আবুবকর সিদ্দিক বলেন, আধুনিক বিশ্বে যে ধরনের পাঠাগার রয়েছে ঠিক সেই আদলেই তৈরি হবে গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর এবং সুফিয়া কামাল জাতীয় গণগ্রন্থাগার ভবনটি। এটি এতটাই আধুনিকভাবে তৈরি করা হবে যে দিনের বেলা পর্যাপ্ত সূর্যের আলো থাকলে বৈদুতিক বাতিরও প্রয়োজন হবে না। গ্লাস প্রোটেক্টেড ব্যবস্থা দিয়ে তৈরি করা হবে ভবন। সেই গ্লাসের বাইরে থাকবে বাংলা বর্ণমালা। আমাদের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ প্রতিফলিত হবে ভবনের ডিজাইনেও।
আগামী চার বছরের জন্য শাহবাগ থেকে সুফিয়া কামাল জাতীয় গণগ্রন্থাগারকে সরিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে। রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পাশে দ্য ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার্স (আইইবি) ভবনের ১২ ও ১৩ নম্বর ফ্লোরে স্থানান্তরিত হচ্ছে। ১ এপ্রিল থেকে সেখানে দেওয়া হবে গ্রন্থাগারটির সেবাগুলো। অপরদিকে গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের প্রধান অফিস স্থানান্তরিত হচ্ছে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের পেছনে বাংলাদেশ সার্ভিসেস লিমিটেডের (বিএসএল) একটি ফ্লোরে। শাহবাগে নতুন ভবন নির্মাণের আগ পর্যন্ত এখান থেকেই গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের কার্যক্রমগুলো পরিচালনা করা হবে। এদিকে পুরোনো ভবন ভেঙে গড়ে তোলা হবে আধুনিক নতুন ভবন। ৫২৪ কোটি টাকা ব্যয়ে যার কাজ সমাপ্তকাল ধরা হয়েছে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত।
গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর, প্রকল্পপ্রধান ইঞ্জিনিয়ারসহ আরও কয়েকটি সূত্রে নির্মিতব্য নতুন ভবনের বিষয়ে বিস্তারিত জানা গেছে। শাহবাগের সুফিয়া কামাল জাতীয় গণগ্রন্থাগারের বর্তমান ভবনটি তিনতলা বিশিষ্ট। কয়েক বছর ধরেই এতে ছাত্রছাত্রী, শিক্ষার্থী ও পাঠকদের ভীষণ চাপ লক্ষ করা যায়। এ কারণে সেখানে জায়গার সংকুলান হচ্ছিল না। এমনকি পুরোনো ভবনটি মাঝেমধ্যে কেঁপে উঠত বলেও নিশ্চিত হওয়া গেছে। সেই জায়গায় নতুন ভবনে আধুনিক পাঠাগারের সব সুবিধা পাওয়া যাবে। নতুন ভবনটি নির্মাণ করা হচ্ছে আগামী ২০ বছরের কথা মাথায় রেখে। অর্থাৎ আগামী ২০ বছরে শিক্ষার্থী-পাঠকের সংখ্যা যতই বাড়ুক না কেন, তাদেরকে পড়ার বা গবেষণার জন্য এখানে জায়গা দেওয়া যাবে।
নতুন ভবনে সায়েন্স রিডিং রুমে বসার ব্যবস্থা দ্বিগুণ রাখা হচ্ছে। সাধারণ পাঠকদের ধারণক্ষমতা আগের ভবনের তুলনায় প্রায় তিনগুণ বাড়ানো হচ্ছে। যারা গবেষণার জন্য পড়াশোনা করতে বা তথ্য নিতে আসবেন, তাদের জন্য রাখা হচ্ছে আলাদা জোন। শিশুদের পড়াশোনার জন্য রাখা হচ্ছে আলাদা জোন। প্রতিবন্ধীদের জন্য বর্তমান ভবনে কোনো ব্যবস্থা ছিল না। নতুন ভবনে প্রতিবন্ধীদের পড়াশোনার জন্য ব্রেইল সেকশনসহ আলাদা জোন রাখা হচ্ছে। বয়স্ক নাগরিকদের পড়ার জন্য আলাদাভাবে পুরো একটি ফ্লোর থাকছে এতে।
ডিজিটাল সেকশন বলে আলাদা স্থান রাখা হচ্ছে, যেখানে শুধু ডিজিটাল কনটেন্ট থাকবে। ডিজিটাল প্ল্যাটফরম ব্যবহারের সুযোগ-সুবিধা থাকছে। প্রতিটি কম্পিউটার আলাদা লাইব্রেরি হিসাবে পাঠক বসে ব্যবহার করতে পারবেন। ডিজিটাল ইকুইপমেন্টগুলো এমনভাবে সংযুক্ত থাকবে যাতে একজন পাঠক হার্ডকপির পাশাপাশি ডিজিটাল লাইব্রেরি ব্যবহার করতে পারেন। বাংলাদেশ ও বিশ্বের নামিদামি সব লাইব্রেরিতে প্রবেশের ব্যবস্থা করা হবে।
জানা যায়, এই প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৭৫ কোটি টাকা রাখা হয়েছে শুধু ডিজিটাল বই কেনার জন্য। গণগ্রন্থাগারের মাধ্যমে বিশ্বের নানা প্রান্তের জার্নালগুলো কেনা হবে এবং সেগুলো অনলাইনে সাবসক্রিপশন দিয়ে পাঠকের জন্য পড়ার সুবিধা রাখা হচ্ছে। আর সুফিয়া কামাল জাতীয় গ্রন্থাগারে থাকা প্রায় দুই লাখ বইকে ই-বুকে রূপান্তরিত করার কাজ শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে ১৮ হাজার ৫০০ বইকে ই-বুকে রূপান্তর করা হয়েছে। বাকি বইগুলো পর্যায়ক্রমে ই-বুকে রূপান্তর করার কাজ চলমান আছে। পাঠক সেই বইগুলোও ব্যবহার করতে পারবেন। পাঠাগারে রাখা হচ্ছে বেশকিছু রেস্টহাউজ। সেখানে বিদেশি গবেষক কেউ পাঠাগারে অবস্থান করে গবেষণা করতে চাইলে সুযোগ দেওয়া হবে। ১১তলা ভবনের প্রথম দুইটি বেজমেন্ট। যেখানে ১৩০টির মতো প্রাইভেট কার ও ১২৫টির মতো মোটরসাইকেল রাখার ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে। মাঝে প্লাজা লেভেল রাখা হবে বিশাল খোলামেলা জায়গা। থাকবে ক্যাফেটেরিয়া। ‘গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের বহুতল ভবন নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্পের অর্থায়ন পুরোপুরি সরকারিভাবে করা হচ্ছে।