ফ্রিডমবাংলানিউজ ডেস্ক | আপডেট: বুধবার, আগস্ট ২৫, ২০২১
আজ রাজাও নেই, রাজার পাশে থাকা মন্ত্রী কিংবা উজির নাজিরও নেই। রূপকথার গল্পের মতো চমৎকার একজন রাজার চারপাশে যেসব অমাত্যরা তাকে ঘিরে থাকে, সঙ্কটকালে বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়, তেমন কোনো কিছুই একবিংশ শতাব্দীর রাষ্ট্রযন্ত্রে আমরা দেখতে পাই না। বরং এখানে আছে আমলা, এবং তাদের আমলনামা।
আমলাদের নিয়ে চমৎকার একটি সংজ্ঞা আছে। তাতে বলা হয়েছে, আমলারা হচ্ছে রাষ্ট্রযন্ত্রের এমন একটি অনুষঙ্গ, যেখানে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের বেলায় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের চেয়ে আমলাদের বা রাষ্ট্রযন্ত্রের কর্তাব্যক্তিদের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
আমলা ও মন্ত্রীদের মাঝে বেশ বড় একটি ফারাক আছে। আর সে ফারাকটি হলো সরকার বদল হলে মন্ত্রী বদলে যায়, কিন্তু আমলারা স্বীয় অবস্থানে বহাল তবিয়তেই থাকেন। রাজনীতিবিদদের ক্ষেত্রেও ঠিক একই কথা খাটে। তাই বলা যায় একটি দেশের প্রশাসন যেন ঠিকভাবে চালু থাকে, সেজন্য চালকের আসনে আদতে বসে থাকেন আমলারাই। তাদের হাতেই দেশ গড়ার ও বিনির্মাণের ড্রাইভিং হুইল। আর সেখানে রাজনীতিবিদরা এখন পিছু হটতে বাধ্য হচ্ছেন। মাঠের খেলায় বলতে গেলে ফাঁকা মাঠেই একের পর এক গোল দিয়ে যাচ্ছেন আমলারা। তবে সেটি ইতিবাচক নয়, বরং নেতিবাচকভাবেই উঠে আসছে।
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসবার পর থেকে নানা সুবিধা দিয়ে যাচ্ছেন আমলাদের। তাদের আগের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করা হয়েছে, মৌলিক অধিকারগুলো বাড়ানো হয়েছে বহুগুণে। এছাড়াও সরকারি নানা সুযোগ-সুবিধা আমলারা পাচ্ছেন অবিরাম। এই আমলাদের কাছে সরকারের চাওয়া কী থাকতে পারে? তারা যেন দেশের প্রশাসনিক কাজগুলো সঠিক, সুন্দরভাবে করতে পারেন। তবে এখন আমলারা কেন যেন রাজনীতিবিদদের চেয়েও বেশি “রাজনৈতিক” হয়ে উঠছেন। করোনা মহামারীর সময়েই সেটি আমাদের চোখে বেশি প্রকট হয়ে উঠেছে। একের পর এক অনভিপ্রেত কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আমলারা হচ্ছেন পত্রিকার পাতা ও খবরের কাগজের শিরোনাম। মানুষ গালাগাল দিচ্ছে সরকারকে। আওয়ামী সরকারের যত অর্জন এবং সুনাম ছিল, বলা যেতে পারে আমলা এবং আমলাতন্ত্রের কারণের তা ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে যাচ্ছে। রাজনীতিবিদেরা তাদের কাজগুলো ঠিকভাবে করতে পারছেন না। সেখানকার ফায়দা লুটে যাচ্ছেন আমলারা। আমলারা সরকারের চাকর নন। তারা রাষ্ট্রের চাকর। সরকার বদল হলেও তারা তাদের অবস্থানে থাকবেন। আর জনগণের কাছেও তারা জবাবদিহি করছেন না। ফলে সরকারের সাথে জনগণের যে একটি সেতুবন্ধন রয়েছে, তাতে ধীরে ধীরে ফাটল ধরছে।
মোদ্দা কথায় বলতে গেলে, আমলাদের কারণে সরকার এখন বেশ বিব্রত। তাদের অপতৎপরতা এবং অনভিপ্রেত কর্মকাণ্ডের কারণে সরকারকে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে, যা আমাদের মোটেও কাম্য নয়।
শুরু থেকেই মানের অধঃক্রম হিসেবে আমলাদের নজিরবিহীন কিছু দৌরাত্ম্যের উদাহরণ দেয়া যাক-
১) প্রথমেই আসা যাক জামালপুরের ডিসি আহমেদ কবীরের কথায়। নারী কেলেঙ্কারির ঘটনায় তিনি বেশ আলোচিত। এমনকি আজকাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও তার নাম ও পদকে কেন্দ্র করে হাস্যরসের আয়োজন করা হয়ে থাকে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত জানা গিয়েছে, তাকে নিম্নপদে নামিয়ে দেয়া হয়েছে। তিনি উপসচিবই থাকবেন, পদোন্নতি হবে না।
২) এক নারী ব্যাংক কর্মকর্তার সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কের অভিযোগ উঠেছে বাগেরহাটের ডিসি আ. ন. ম. ফয়জুল হকের বিরুদ্ধে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব বরাবর লিখিতভাবে এ অভিযোগ করেছেন ওই নারীর স্বামী। এ অভিযোগ ওঠার এক মাসের মাথায় আ. ন. ম. ফয়জুল হককে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার পরিকল্পনা বিভাগে বদলি করা হয়।
৩) মাঝরাতে অবৈধ ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে ঢাকা ট্রিবিউন সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগানকে সাজা দেওয়া এবং নির্যাতনের ঘটনায় লঘু শাস্তি (মাত্র দুই বছর বেতন বৃদ্ধি রহিত) সাজা পান কুড়িগ্রামের তৎকালীন ডিসি সুলতানা পারভীন।
৪) এরপর এলো গৃহহীনদের ঘর ভেঙে পড়ার ঘটনা। প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের অধীনে গৃহহীনদের ঘর বানিয়ে দেবার সাথে সাথেই এটি ভেঙে পড়ল, যার কারণে সরকারকে বেশ বিব্রতকর অবস্থার মুখোমুখি হতে হয়েছে।
৫) খুব সম্প্রতি পোষ্টার ছেঁড়ার ঘটনায় বরিশালে ঘটে যায় একটি অনভিপ্রেত ঘটনা। বরিশালের মেয়র বনাম প্রশাসনের দ্বান্দ্বিক পরিণতি কিছুটা সমাধান হলেও আমাদের ভবিষ্যতের এক অশনি সঙ্কেতের বার্তা দেয়। রাজনীতিবিদ এবং আমলাদের মাঝে যে একটি ঠাণ্ডা লড়াই চলছে, সেটিই আমাদের সামনে আরেকবার প্রতীয়মান হয়ে ওঠে।
বরিশালের ঘটনায় আমরা বেশ কিছু জিনিস আমাদের সামনে দেখতে পাই। মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ ও ইউএনওর মাঝে যে ঘটনা, তাতে মানুষ কিন্তু কিছুটা রাজনীতিবিদদের দিকেই ঝুঁকেছিল। কিন্তু অবস্থা পাল্টে যায় একটি বিবৃতির প্রেক্ষাপটে। বাংলাদেশ এ্যাডমেনিটেটিভ এসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে যে এই ঘটনা সম্পর্কে যে বিবৃতি দেয়া হয়েছিল, তা ছিলো আপত্তিকর, শিষ্টাচার বহির্ভূত এবং ঔদ্ধত্যপূর্ণ। এই বিবৃতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হবার পরপরই পরিস্থিতি পাল্টে যায়। যারা সাদিক আবদুল্লাহর সমালোচনায় মুখর ছিলেন, তার পর্যন্ত আমলাদের ধৃষ্টতা দেখে ক্ষুব্ধ হন।
বিবৃতিতে স্পষ্ট বলা হয় যে, “বাংলাদেশ এডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস এসোসিয়েশন এমন কার্যকলাপের তীব্র নিন্দা জানায় এবং বরিশালের মেয়র যার অত্যাচারে সমগ্র বরিশালবাসী অত্যন্ত অতিষ্ট, সেই সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ-র হুকুমেই এই ঘটনা সংঘটিত হয়েছে বলে তাঁরা মনে করেন।”
এছাড়াও প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে অসংখ্য ভুলে ভরা এবং দ্বিমুখী। ঘটনার চারদিন পর (২৩ আগস্ট) কেন সচিবরা বললেন যে তাঁরা এর দ্বিমতে? এই মতপ্রকাশ করতে চারদিন সময় কেন তাঁরা নিলেন? আমরা এর আগেও দেখেছি যে আমলারা কেন যেন বাইন মাছের মতো বারবার কোনো একটি ঘটনা ঘটলেও পিছলে যান। আর তাদের যত বড় অপরাধই হোক না কেন, শাস্তিটা লঘুই হয়। ওএসডি করে রাখা, বেতন বাড়িয়ে না রাখা (সাময়িক), পদোন্নতি না দেয়া ইত্যাদি শাস্তির মাধ্যমে আসলে দৃষ্টান্ত স্থাপন হয় না।
এটি শেষ হতে না হতেই আমাদের সামনে আসে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব রওনক মাহমুদের কাণ্ড। নিজের করোনাক্রান্ত মায়ের চিকিৎসার জন্য তিনি নিয়োজিত করেন একজন উপ-সচিবসহ মোট ২৪ জন কর্মকর্তা কর্মচারীকে। সরকারী কর্মকর্তারা রাষ্ট্র বা জনগণের জন্য নিয়োজিত নাকি ওপরের পদের কারো ব্যক্তিগত সেবায় নিয়োজিত, সেটি নিয়ে আমরা সন্দিহান হই।
সময় এসে গিয়েছে আমলাতন্ত্রের দিকে নজর দেবার। দরকার হলে তাদের ক্ষমতা ও যথেচ্ছা স্বাধীনতাকে স্তিমিত করার। নইলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সোনার বাংলাদেশ গড়বার যে স্বপ্ন, সেটি এই আমলা বনাম রাজনীতিবিদদের মধ্যকার সংঘর্ষে খর্ব হতে খুব বেশি সময় লাগবে না।
সৌজন্যে: বাংলাইনসাইডার