জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর দুই মাসের মাথায় গ্যাসের দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা শুরু হয়েছে। এ মাসের শুরুতেই দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় জ্বালানি বিভাগ। তড়িঘড়ি করে গত সপ্তাহে দ্বিগুণের বেশি বাড়ানোর প্রস্তাব জমাও দিয়েছিল গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো। বিধিসম্মত না হওয়ায় ‘দায়সারা’ সেই প্রস্তাব গ্রহণ করেনি বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)।
বিইআরসির উচ্চপর্যায়ের দুজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে এটি নিশ্চিত করেছেন। তাঁরা বলছেন, গ্যাসের দাম বাড়ানোর আবেদন করতে হলে প্রবিধানমালা মেনে প্রস্তাব জমা দিতে হবে। বিতরণ কোম্পানি তা মানেনি। নিরীক্ষা প্রতিবেদনসহ প্রয়োজনীয় নথি জমা দেয়নি। তাই তাদের নিয়ম মেনে আবেদন করতে বলা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত বৈধ কোনো আবেদন জমা পড়েনি।
এলএনজি আমদানির সুযোগ থাকায় আমলারা গ্যাস অনুসন্ধানে জোর দেননি। তেলের পর গ্যাসের দাম বাড়ালে মূল্যস্ফীতি বাড়ার চরম ঝুঁকি তৈরি হবে। তাই খোলাবাজার থেকে না কিনে প্রয়োজনে রেশনিং করা উচিত।
৩ জানুয়ারি বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন পেট্রোবাংলাকে চিঠি দিয়ে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিতে বলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। ভর্তুকির চাপ সামলাতে এমন সিদ্ধান্তের কথা জানায় তারা। এরপর ছয়টি গ্যাস বিতরণ কোম্পানি অভিন্ন প্রস্তাব তৈরি করে। আবাসিকে দুই চুলায় ৯৭৫ থেকে বাড়িয়ে ২ হাজার ১০০ টাকা ও এক চুলায় ৯২৫ থেকে বাড়িয়ে ২ হাজার টাকা করতে চায় তারা। আবাসিকে প্রিপেইড মিটার, শিল্প, সিএনজি, বিদ্যুৎ, ক্যাপটিভে (শিল্পকারখানায় নিজস্ব উৎপাদিত বিদ্যুৎ) ব্যবহৃত গ্যাসের দামও দ্বিগুণের বেশি করার দাবি তাদের।
তবে বিইআরসির দুজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, সারা দেশে এখন দিনে গড়ে ৩০০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়। এর মধ্যে ২৩০ কোটি ঘনফুটের (৭৮ শতাংশ) বেশি আসে নিজস্ব গ্যাসক্ষেত্র থেকে। আর কাতার ও ওমানের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি হয় মোট সরবরাহের ১৭ শতাংশ। আর ৫ শতাংশ আন্তর্জাতিক খোলাবাজার থেকে প্রয়োজন বুঝে কেনা হয়। যদিও গত দুই মাস ধরে এটি কেনা বন্ধ আছে। মাত্র ৫ শতাংশ গ্যাসের বাড়তি দামের নামে গ্যাসের দাম দ্বিগুণ করা দূরে থাক, বাড়ানোরই কোনো যৌক্তিকতা দেখছেন না কমিশনের এ দুই কর্মকর্তা।
পেট্রোবাংলা সূত্র বলছে, গত মাস থেকেই দেশে গ্যাস সরবরাহে সংকট শুরু হয়েছে। আগামী এক মাসেও সংকট কাটার সম্ভাবনা নেই। বাসায় চুলা জ্বলছে না। শিল্পকারখানা বন্ধ রাখতে হচ্ছে গ্যাসের অভাবে। মহেশখালীতে ভাসমান দুটি এলএনজি টার্মিনালের একটি বন্ধ হয়ে আছে। বাকি একটি দিয়ে প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ করা যাচ্ছে না। গতকাল মাত্র ৪০ কোটি ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ করা হয়েছে। দিনে মোট সরবরাহ ছিল ২৭০ কোটি ঘনফুটের মতো। এর ২৩০ কোটি ঘনফুট দিয়েছে দেশের গ্যাসক্ষেত্র।
বিইআরসির চেয়ারম্যান আবদুল জলিল প্রথম আলোকে বলেন, বিতরণ কোম্পানিগুলোর প্রস্তাবে প্রয়োজনীয় তথ্য দেওয়া হয়নি, মূল্যবৃদ্ধির আবেদনও যথাযথ হয়নি। প্রবিধানমালা মেনে প্রস্তাব দিতে বলা হয়েছে। প্রস্তাব জমার পর তা যাচাই-বাছাই করে কমিশনের কারিগরি কমিটি মূল্যায়ন প্রতিবেদন দেবে। এরপর তা আমলে নেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে কমিশন।
জানা গেছে, কমিশন আমলে নিলে প্রস্তাব নিয়ে গণশুনানি হবে। এরপর দাম বাড়ানো বা না বাড়ানোর বিষয়ে কমিশন আদেশ দেবে। এর আগে ২০০৮ সালে বিতরণ কোম্পানির দেওয়া ৬৫ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব খারিজ করে দিয়েছিল কমিশন। সব কোম্পানি মুনাফায় থাকায় দাম না বাড়িয়ে গ্যাস উন্নয়ন তহবিল গঠন করা হয়। সর্বশেষ ২০১৯ সালে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছিল।
পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে উৎপাদিত প্রতি ইউনিট (হাজার ঘনমিটার) গ্যাসে পেট্রোবাংলার খরচ দুই টাকার কিছু বেশি। আর দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় এলএনজি আনতে এখন ইউনিটপ্রতি খরচ পড়ছে ৩৮ টাকা। বর্তমান দামে খোলাবাজার থেকে আমদানি করতে হলে ইউনিটে খরচ হবে ৮৫ টাকা। এ হিসেবে গড়ে ইউনিটপ্রতি খরচ ধরে দাম দ্বিগুণ করতে চায় বিতরণ কোম্পানি।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববাজার থেকে এখন এলএনজি আমদানি করা হলে ৮৫ টাকা ৫০ পয়সা খরচ পড়ে যাবে। এতে সব মিলে পেট্রোবাংলার প্রতি ইউনিট গ্যাস সরবরাহের গড় খরচ পড়বে ২১ টাকা। আর বর্তমানে গ্রাহকের কাছে গ্যাস বিক্রি হচ্ছে গড়ে ৯ টাকা ৩৭ পয়সায়।
জ্বালানি বিভাগ ও পেট্রোবাংলা সূত্র বলছে, গত অর্থবছরেও সরকারি তহবিলে কয়েক শ কোটি টাকা জমা দিয়েছে পেট্রোবাংলা। সরকারি ছয় গ্যাস বিতরণ কোম্পানি তিতাস, কর্ণফুলী, জালালাবাদ, বাখরাবাদ, সুন্দরবন ও পশ্চিমাঞ্চল মুনাফা করেছে সর্বশেষ বছরেও। একইভাবে মুনাফা করেছে সরকারি গ্যাস সঞ্চালন কোম্পানি জিটিসিএল।
পেট্রোবাংলা বলছে, বিতরণ কোম্পানি গ্যাস বিক্রির কমিশন পায়। তাদের তো লোকসানের কিছু নেই। কিন্তু গ্যাস উৎপাদন ও সরবরাহ নিশ্চিত করতে গিয়ে লাভ-লোকসানের হিসাব করতে হয় পেট্রোবাংলাকে। বিতরণ কোম্পানি গ্যাস বিক্রি করে বাড়তি আয় করতে না পারলে সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি আনতে হয় পেট্রোবাংলাকে।
জ্বালানি বিভাগে একটা গণবিরোধী চরিত্র কাজ করছে বলে মনে করছেন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এম শামসুল আলম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এলএনজি আমদানির সুযোগ থাকায় আমলারা গ্যাস অনুসন্ধানে জোর দেননি। তেলের পর গ্যাসের দাম বাড়ালে মূল্যস্ফীতি বাড়ার চরম ঝুঁকি তৈরি হবে। তাই খোলাবাজার থেকে না কিনে প্রয়োজনে রেশনিং করা উচিত।