ফ্রিডমবাংলানিউজ ডেস্ক | আপডেট: শুক্রবার, আগস্ট ১৩, ২০২১
ধীরে ধীরে একটি মহীরুহ যখন দৃশ্যমান হয় এবং ছায়াপ্রদান শুরু করে, তাকে ঘিরে নানা আশাভরসার সৃষ্টি হয়। আমাদের কাছে পদ্মাসেতুও ঠিক তেমনই। শুরু থেকেই পদ্মাসেতুকে নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা এবং গুজবের তৈরি হয়েছিল। এমনও বলা হয়েছিল যে পদ্মাসেতু তৈরি করতে চাই মানুষের তাজা রক্ত আর কাটা মুণ্ডুর নৃত্য। মোটকথায়, মানুষের মনে যত ধরনের ভয় ধরানো সম্ভব, তার সবকিছুই এই পদ্মাসেতুকে ঘিরে তৈরি হয়েছে। শুরুতে মানুষের মনে একটি দ্বিধা ছিল, নিজস্ব অর্থায়নে যেভাবে বলা হয়েছে, এমন বিশাল একটি সেতু আসলেই তৈরি করা সম্ভব কিনা। কিন্তু যখন পদ্মাসেতু নামের বিশাল এক মহীরুহ আমাদের দৃশ্যমান হলো, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখেছি মানুষের মধ্যে কী পরিমাণ আনন্দ তৈরি হয়েছে। কষ্টের পর যখন কেষ্ট মেলে, তখন আমাদের মনে খুশি আসাই কিন্তু স্বাভাবিক।
কিন্তু এখন একের পর এক পত্রিকার পাতায়, খবরের শিরোনামে আমরা দেখতে পাচ্ছি ভিন্ন কথা। প্রাণের পদ্মাসেতুকে একের পর এক আঘাতে জর্জরিত হতে হচ্ছে।
প্রথম ঘটনাটি ঘটে জুলাই মাসের শেষ হপ্তায়। অসতর্ক মাস্টার ও সুকানির কারণে ফেরি শাহজালাল পদ্মাসেতুর সাথে ধাক্কা খেয়েছিল। ওই ঘটনায় তাদেরকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছিল। তখন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন এটি নিছক অসতর্কতা নাকি ষড়যন্ত্র, তা ভালোভাবে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। চার হাজার টনের জাহাজের ধাক্কাও যে সেতুর সামাল দেবার কথা, সে একই সেতু ফেরির আঘাতে টালমাটাল হয়ে যাচ্ছে কীভাবে?
এরপরের ঘটনাটি এই আগস্ট মাসের ৯ তারিখে ঘটল। সন্ধ্যায় বাংলাবাজার ঘাট থেকে ছেড়ে আসা ‘বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর’ নামের একটি ফেরি পদ্মা সেতুর ১০ নম্বর খুঁটিতে আঘাত করে। একটি ট্রাকের চাপায় একটি প্রাইভেট কার দুমড়ে-মুচড়ে গেছে। এতে দুইজন আহত হয়। আহতদের হাসপাতালে পাঠানো হয়। আঘাতের পর ২৭টি যানবাহন ভর্তি রোরো ফেরিটির পেছনের অংশে হু হু করে পানি ঢুকে পড়ে।
এবারের ঘটনাটি আরও তরতাজা। আজ শুক্রবার (১৩ আগস্ট) সকাল ৮টার দিকে মাদারীপুরের বাংলাবাজার থেকে মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া যাওয়ার পথে পদ্মা সেতুর ১০ নম্বর পিলারে কাকলি নামে ছোট একটি ফেরি ধাক্কা দিয়েছে।
মূল কথায় আসি। পদ্মা সেতুর চারপাশে বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের মতো রহস্যময় কিছু আছে কিনা, তা বিজ্ঞানমনস্করা চাইলে খুঁটিয়ে দেখতে পারেন। তবে যদি ইতিহাসের দিকে একটু লক্ষ্য করি, তাহলে দেখব কুচক্রীরা যখন একটি দেশের সভ্যতাকে নস্যাৎ করতে চায়, তখন প্রথমে সে দেশের স্থাপনার দিকে নজর দেয়। গজনীর সুলতান মাহমুদের কথাই ধরুন না কেন! মোট ১৭ বার ভারত অভিযান করেছিলেন তিনি। লুণ্ঠন করেছিলেন উপমহাদেশের সম্পদ, উড়িয়ে দিয়েছিলেন সভ্যতার পরিচায়ক চিহ্নগুলো। বাংলাদেশের ইতিহাসে পদাসেতুর মতো এমন একটি স্থাপনা বিরল। কুচক্রী মহলের দৃশ্য এদিকে থাকবে, তা তো বলাই বাহুল্য।
প্রথমদিকে যখন পদ্মাসেতুতে ফেরির আঘাত হানে, সেটিকে অসতর্কতা বলে নাহয় মানা গেলো। কিন্তু সেখানেও কথা আছে। পদ্মাসেতু তৈরি হতে ৬ বছর সময় লেগেছে। এতদিন সেখানে কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি, বা ঘটার মতো কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। হুট করেই সেখানে এখন কেন দুই-এক হপ্তা পরপরই ফেরির ধাক্কা লাগছে? পদ্মা সেতুর অর্জনকে বানচাল করার জন্যই এমন করা হচ্ছে না তো?
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে বলা হচ্ছে এটি ফেরি চালকদের অদক্ষতা। প্রশ্ন হচ্ছে, হুট করেই এই অদক্ষতা প্রকাশিত হয়ে গেলো? তাহলে তারা এতদিন কেন অপেক্ষা করেছিলেন? পদ্মাসেতুর মতো এত গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থাপনার নিচ দিয়ে যখন কোনো ভারী জলযান যায়, স্বভাবতই সেটিকে অতি সাবধানে চালাতে হবে। ফিটনেসহীন কোনো জলযান চালানো হচ্ছে কিনা, বা অদক্ষ কোনো চালকের হাতে নৌ যান যাচ্ছে কিনা, সেটিও তদন্তের আওতায় আনতে হবে। দুদিন পর পর পত্রিকার পাতায় এমন সংবাদ আমাদের কারোরই কাম্য নয়।
আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, প্রতিবারই এমন ঘটনা ঘটবার পর বলা হচ্ছে যে জায়গায় পদ্মাসেতুর ওপর আঘাত আসছে, সেখানে পদ্মার উত্তাল স্রোত থাকে। তাহলে স্প্যানিং বসানোতে কোনো ঝামেলা হলো কিনা, সেটিও দেখতে হবে। উত্তাল নদীর বাঁকে ঠিক সে জায়গাটিতেই জলযান ঘুরে যায় কিনা বা তাল হারিয়ে ফেলে ধাক্কা খাচ্ছে কিনা, সেটিও তদন্তের আওতায় আনতে হবে। নাকি এটিই প্রকৃত কারণ, যা সংশ্লিষ্টরা নিজেদের দায় হিসেবে মেনে নিতে কুণ্ঠাবোধ করছেন? যদি তাই হয়ে থাকে, এ থেকে উত্তোরণের উপায় কী, সেটিও আমাদের ভালোভাবে দেখতে হবে।
সর্বোপরি, পদ্মাসেতুকে আঘাতে জর্জরিত হচ্ছে, এমন কোনো সংবাদ আমরা আর দেখতে চাই না। কুচক্রী মহলের সকল ষড়যন্ত্র যেন বানচাল হয়ে যায়, সেদিকে আমাদের দৃষ্টি দেয়াটা জরুরী।