ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপর্যয় কাটছেই না। গত ২৬ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সর্বশেষ পর্যায়ের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, বিদ্রোহী প্রার্থীদের দাপট এবং আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের ভরাডুবি নজরে এসেছে। বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীরা ধরাশায়ী হয়েছেন। শুধুমাত্র যে সমস্ত স্থানে শক্ত নেতৃত্ব ছিলো সে সমস্ত স্থানে আওয়ামী লীগ তার বিজয় ধরে রাখতে পেরেছে। কিন্তু দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা যে রকম ভাবে পরাজিত হয়েছে তা আওয়ামী লীগের জন্য একটা সতর্ক সংকেত বটে। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে ধাপে ধাপে। প্রতি ধাপে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেই আওয়ামী লীগের এই বিপর্যয় চোখে পড়েছে। এবার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিএনপি ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেছে। তারা দলীয় প্রতীকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। নারায়ণগঞ্জে যেভাবে তৈমুর আলম খন্দকার স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন সেভাবে বিএনপি প্রার্থীরাও ইউনিয়ন পরিষদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল এবং এর ফলে তাদের সুবিধা হয়েছে একাধিক। প্রথমত, তারা তাদের মত করে প্রচারণা করতে পেরেছে। দ্বিতীয়ত, আওয়ামী লীগের মধ্যে বিভক্তি অক্ষত রাখতে পেরেছে। তৃতীয়ত, তারা তাদের পছন্দের ব্যক্তিকে ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বাধীনতা পেয়েছে। এর ফলে এবারের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপি অনেক ক্ষেত্রে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে।
আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে প্রতীক দেওয়ার ক্ষেত্রে অনড় ছিল। বিশেষ করে তৃতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের পরে আওয়ামী লীগের মধ্যে অনেকে ধারণা করেছিল যে, আওয়ামী লীগ হয়তো নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহারের অবস্থান থেকে সরে আসবে কিন্তু তারা সেই অবস্থান থেকে সরে আসেনি। ফলে ২৬ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আবার নৌকা প্রতীকে পরাজয় ঘটেছে। যদিও এই সময়ে নৌকা প্রতীকের বিরোধিতাকারী একাধিক নেতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে এবং যারা নৌকার বিরুদ্ধে কাজ করেছে তাদেরকে চিহ্নিত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কিন্তু এই সমস্ত উদ্যোগ, ব্যবস্থা কোন কিছুই কাজে লাগেনি। আওয়ামী লীগের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা বলছেন যে, বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে যতই ব্যবস্থা নেয়া হোক না কেন বিদ্রোহ বন্ধ করাটা এত সহজ নয়। কারণ ইউনিয়ন পরিষদই হলো ক্ষুদ্রতম একক। এখানে ভোট হয় ব্যক্তির পরিচয়ে এবং ব্যক্তির পরিবার, সম্পর্ক ইত্যাদি বিবেচনায়। এখানে দলীয় প্রতীক খুব সামান্যই ভূমিকা পালন করে। কিন্তু আওয়ামী লীগ ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত তৃণমূলে যে দলীয় প্রতীকের ব্যবস্থা করেছিল সেটি যদি সংঘটিত রাজনৈতিক দল হতো তাহলে তা ইতিবাচক ফল দিতো। কিন্তু আওয়ামী লীগ একটি বহু মাত্রিক রাজনৈতিক দল। এখানে বিভিন্ন ধরনের লোক, শ্রেণি-পেশার মানুষ জড়ো হয়। কাজেই আওয়ামী লীগের মতো একটি দল একজন প্রার্থীকে দাড়া করিয়ে তার প্রতি অনুগত হতে বাধ্য করাটা অবান্তর চিন্তা এবং সেটির ফলই হয়েছে। যার ফলে আওয়ামী লীগ, আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েছে। কিন্তু সমস্যা যেটি হয়েছে তা হলো আওয়ামী লীগ, আওয়ামী লীগের মাঝে যে খুনোখুনি হয়েছে তা স্থানীয় পর্যায়ে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষত সৃষ্টি করেছে। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এই ক্ষত সারিয়ে উঠবে কিভাবে সেটি একটি বড় প্রশ্ন।
তাছাড়া বিদ্রোহী প্রার্থীদের ব্যাপারে আওয়ামী লীগের দ্বিমুখী সিদ্ধান্ত সমালোচিত হচ্ছে। যারা বিজয়ী হচ্ছেন তাদেরকে দলের মধ্যে বরণ করে নেয়া হচ্ছে, আর যারা পরাজিত হচ্ছেন তাদেরকে বহিষ্কার করা হচ্ছে। এ রকম অবস্থার কারণে বিদ্রোহীরা উৎসাহ পাচ্ছে। আওয়ামী লীগের অনেকে নেতাই মনে করেন যে, এটি সমাধানের একমাত্র উপায় হলো আগামীতে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রতীকের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা। কারণ দলীয় প্রতীকে নির্বাচন যতক্ষণ হবে ততক্ষণ ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে এই বিভক্তি-খুনোখুনি হতেই থাকবে। এটি শুধু আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, যারা যখন ক্ষমতায় থাকবে তারাই দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করলে এরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হতেই হবে। কাজেই আওয়ামী লীগ এখন দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের অবস্থান থেকে সরে আসবে কিনা সেটাই দেখার বিষয়।