পয়লা জানুয়ারি শুরু হবে ২০২২ শিক্ষাবর্ষ। এক যুগ ধরে এদিন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন পাঠ্যবই তুলে দেওয়া হচ্ছে। মাত্র ১১ দিন বাকি থাকলেও সরকারি হিসাবেই এখন পর্যন্ত ৭ কোটি বই ছাপানো বাকি। এর মধ্যে মাধ্যমিকের ৫ কোটি ৭২ লাখ, আর প্রাথমিকের ১ কোটি ৩০ লাখ।
তবে মুদ্রণসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বই ছাপা না হওয়ার প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) হিসাব অনুযায়ী, প্রাথমিকে ৮ কোটি ৬৭ লাখ ৫৯ হাজার আর মাধ্যমিকে প্রায় ১৯ কোটি ছাপা হলেও তা সরবরাহে আরও কয়েকদিন লেগে যেতে পারে। কেননা বই মুদ্রণের পর তা বাঁধাই, কাটিংসহ আরও কিছু পর্যায় বাকি থাকে। এরপর তা বিভিন্ন উপজেলায় পাঠানো হয়।
যদিও এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলছেন, প্রায় প্রতিবছরই বই ছাপানোয় সংকটের কথা বলা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা তা পেয়ে যায়। এবারও এর ব্যত্যয় হবে না। কাজ শেষ করার বিভিন্ন কৌশল নেওয়া হয়েছে। ২৫ ডিসেম্বরের মধ্যে যে কোনো মূল্যে কাজ শেষ করা হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, পাঠ্যবইয়ের কাজ বিলম্বের পেছনে তিনটি কারণ আছে। প্রথমত, করোনা পরিস্থিতির কারণে এবার এনসিটিবি যথাসময়ে মুদ্রণসংক্রান্ত কাজ শুরু করেনি। একই কারণে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে এ সংক্রান্ত ফাইল অনুমোদনে বিলম্ব হয়। এছাড়া এনসিটিবি কর্মকর্তাদের দরপত্রের তফশিল তৈরিতে ভুল এবং দরদাতারা সিন্ডিকেট করায় বিভিন্ন কাজের দরপত্র একাধিকবার ডাকতে হয়েছে।
তবে মুদ্রাকরদের পক্ষ থেকেও একটি সংকট আছে বলে জানা যায়। গত বছর মাধ্যমিক স্তরের বইয়ের কভারের দ্বিতীয় ও তৃতীয় পৃষ্ঠায় ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা, মুক্তিসংগ্রাম, বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীবিষয়ক কিছু স্থিরচিত্র ক্যাপশনসহ যুক্ত করা হয়। মূল দরপত্রের অতিরিক্ত হিসাবে এনসিটিবির অনুরোধে এটি ছাপানো হয়। এই কাজে প্রায় ৩ কোটি টাকা এখনো বকেয়া আছে। এই বকেয়ার দায়ভার এনসিটিবি আর মন্ত্রণালয় পরস্পরের দিকে চাপাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে মুদ্রাকরদের কেউ কেউ কাজে গতি কমিয়ে দিয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়া নতুন শিক্ষাক্রম তৈরিতে বিলম্বের কারণে প্রথম ও ষষ্ঠ শ্রেণির পরীক্ষামূলক গ্রন্থের ভার্সন তৈরিও বিলম্বের আরেকটি কারণ। এই ভুলের ধকল কাটাতে সব বই একসঙ্গে দেওয়ার পরিবর্তে এখন তিন ভাগ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জানা যায়, দেরিতে দরপত্রের কাজ করায় এনসিটিবি বই সরবরাহের ক্ষেত্রেও এবার ‘আংশিক’ নীতি গ্রহণ করে। অর্থাৎ, ৩০ ডিসেম্বরে সব বই গ্রহণের পরিবর্তে আংশিক বই পাওয়ার ব্যাপারে চুক্তি করেছে। এবার যে ৩৫ কোটি বই ছাপানো হচ্ছে, এর মধ্যে প্রাথমিক স্তরে আছে ৯ কোটি ৯৮ লাখ। আর মাদ্রাসার দাখিল, ইবতেদায়ি, ভোকেশনাল ও সাধারণ শিক্ষার মাধ্যমিক স্তর মিলিয়ে ছাপানো হচ্ছে ২৪ কোটি ৫১ লাখ ৫৬ হাজার। মাধ্যমিক স্তরের বই দুই ভাগে দরপত্র দেওয়া হয়। প্রথম ভাগে অষ্টম-নবম আর ইবতেদায়ির তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির বই ছাপানোর চুক্তি হয় ৮ নভেম্বর। এই দরপত্রে মুদ্রাকরদের ৮৪ দিন সময় দেওয়া হয়েছে। সেই হিসাবে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত তাদের সময় দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি এতে ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে ৫০ শতাংশ বই সরবরাহের শর্ত দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে চুক্তি অনুযায়ী, মাধ্যমিকের ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণি এবং ইবতেদায়ির প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির বই সরবরাহে ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় পাচ্ছেন মুদ্রাকররা। এই দরপত্রে বই সরবরাহে সময় দেওয়া হয় ৭০ দিন। সেই হিসাবে ১৭ ডিসেম্বরের মধ্যে অর্ধেক বই সরবরাহের শর্ত দেওয়া হয়।
মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি তোফায়েল খান যুগান্তরকে বলেন, বই মুদ্রণে সময় অপরিহার্য বাস্তবতা। উৎপাদনের সময় দিতেই হবে। হাতে এখন ১১ দিন সময় আছে। প্রাথমিক স্তর নিয়ে হয়তো সমস্যা হবে না। এর মধ্যে অবশিষ্ট দেড় কোটি বই চলে যাবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত মাধ্যমিকের ছাপাই হয়নি ৭ কোটি বই। আবার ছাপা হয়েছে কিন্তু বাঁধাই-কাটিং হয়নি-বিভিন্ন প্রেসে এমন বই আছে কয়েক কোটি। এসব দৃষ্টিকোণ পর্যালোচনায় বলা যায়, ডিসেম্বরের মধ্যে সর্বোচ্চ ৭০ শতাংশ বই যাবে। বাকি বই সরবরাহে মধ্য জানুয়ারি লেগে যেতে পারে। আর এমনটি হলে আইনগতভাবে এনসিটিবি মুদ্রাকরদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থায় যেতে পারবে না।
সূত্র জানায়, প্রাক-প্রাথমিক স্তরে এবার ৩৪ লাখ শিক্ষার্থী আছে। এসব শিক্ষার্থীকে সরকার অনুশীলন গ্রন্থ বা হাতের লেখার খাতা ‘এসো লিখতে শিখি’ এবং পাঠ্য ‘আমার বই’ দিয়ে থাকে। দরপত্রের তফশিল তৈরিকালে এনসিটিবি ভুল করে কাগজের ক্ষেত্রে অবাস্তব শর্ত আরোপ করে। ওই কাগজ কোথাও নেই। নিজেদের ভুল ঢাকতে সংস্থাটি নতুন করে দরপত্র ডাকে। এ কারণে দ্বিতীয়বার ৮ ডিসেম্বর এই স্তরের পাঠ্যবইটি ছাপতে দেয়। ফলে খাতা চলে গেলেও আটকে গেছে বইটি।
৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ করার তাগিদ দেওয়ায় মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবই নিয়ে নতুন সংকট তৈরি হয়েছে। বেশি কাজ পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে ‘সাব-কন্ট্রাক্ট’ বা অন্য প্রতিষ্ঠানে কাজ করানোর সুযোগ দেওয়া হয়েছে। ফলে বই ছাপার কাজ তদারককারী প্রতিষ্ঠান ও টিমগুলো সেখানে পরিদর্শনে যেতে পারছে না। ফলে ৮০ গ্রামের কাগজের পরিবর্তে ৬০ গ্রামের এমনকি নিউজপ্রিন্টে বই ছাপা হওয়ার অভিযোগ আছে। কাজ উঠানোর স্বার্থে এনসিটিবিও এদিকটি ‘না’ দেখার ভান করছে। এমন পরিস্থিতিতে নিুমানের বই শিশুদের হাতে চলে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সার্বিক বিষয়ে এনসিটিবি এক সদস্য যুগান্তরকে বলেন, পাঠ্যবই আর ব্রিজ-রাস্তা নির্মাণের কাজ এক নয়। একটি নির্দিষ্ট দিনে শিশুদের হাতে তা তুলে দিতে হয়-সবাই তা জানেন। তাই সময় আর আইনের মারপ্যাঁচ দিয়ে শিশুদের কেউ ভোগান্তিতে ফেলবে না বলে আমরা বিশ্বাস করি। জাতীয় স্বার্থে ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ করার ব্যাপারে মুদ্রাকরদের ‘মোটিভেশন’ করা হচ্ছে। ওই সদস্য আরও বলেন, এর সুফল পাওয়া যাচ্ছে। রোববারও ৬৩ লাখ বইয়ের ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। এই হারে কাজ চললে ১ জানুয়ারির দুদিন আগেই মুদ্রণকাজ শেষ হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। আর সবশেষে দরপত্র হলেও আগামী শনিবারের মধ্যে প্রাক-প্রাথমিকের অর্ধেক বই পাওয়া যাবে।