ফ্রিডম বাংলা নিউজ

শনিবার, জুলাই ৬, ২০২৪ |

EN

‘মরার আগে হাসিনার সাক্ষাৎ চাই’

নিজস্ব প্রতিবেদক | আপডেট: মঙ্গলবার, ডিসেম্বর ১৪, ২০২১

‘মরার আগে হাসিনার সাক্ষাৎ চাই’
শহীদ বুদ্ধিজীবী সৈয়দ আকবর হোসেন বকুল মিয়া। সরাইল সদরের আলীনগর গ্রামের সৈয়দ পরিবারে জন্ম নেয়া এক দেশপ্রেমিক বীরপুরূষের নাম। হাঁসতে হাঁসতে নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছিলেন এই দেশ ও মাটির জন্য। সাথে শহীদ হয়েছিলেন তার ছোট ভাই সৈয়দ আফজাল মিয়াও। তাদের বিধবা স্ত্রী ও চিরদিনের জন্য এতিম হয়ে যাওয়া শিশুদের আর্তচিৎকারে সেইদিন প্রকম্পিত হয়েছিল বাংলার আকাশ-বাতাস। কিন্তু বিন্দু পরিমাণ মায়া জাগেনি বর্বর ঘাতক পাক সেনাদের মনে। আপন দুই ভাইকে লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে পাখির মত নির্মম ভাবে হত্যা করেছিল পাক বাহিনী। তার মত আত্মত্যাগী মহান লোকদের ত্যাগের ফসল আজকের লাল সবুজের পতাকা সম্বলিত স্বাধীন বাংলাদেশ নামের ভূখন্ডটি। বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য আস্থাভাজন বকুল মিয়া এই দেশের একটি ইতিহাসের নাম। এই দেশ ও জাঁতি তাদের আত্মার কাছে চিরকালই ঋণী। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর পরও তার পরিবারটি পায়নি যথাযথ মূল্যায়ন। তারা পায়নি মুক্তিযোদ্ধা ভাতাও। সেইদিন হঠাৎ স্বামীকে হারিয়ে ৪ শিশু সন্তানকে নিয়ে চরম অন্ধকারে পড়েছিলেন নুরূল আক্তার। আর্থিক দৈণ্যদশা তাকে কুড়ে খাচ্ছিল। চোখে শর্ষে ফুল দেখেছিলেন। কঠিন বাস্তবতা ও প্রতিকূলতার মাঝখানে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ ৫০ বছরের আরেক বীর যোদ্ধার নাম নুরূল আক্তার (৭২)। জীবন যুদ্ধে হার মানেননি তিনি। খুবই কষ্ট করেছেন। কিন্তু পিতার অভাব বুঝতে দেননি ৪ শিশু সন্তানকে। বয়সের ভারে বর্তমানে তিনি ন্যুজ¦। এখন দিনরাত ওঁর একটাই স্বপ্ন, ইচ্ছে ও আকুতি। মরার আগে তিনি একটিবার জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনার সাথে সরাসরি সাক্ষাৎ করতে চান। স্বাধীনতা যুদ্ধে যার ডাকে সাড়া দিয়ে ওঁর স্বামী জীবন উৎসর্গ করেছেন। সেই বীর পুরূষের কন্যা শেখ হাসিনার কাছে গিয়ে সেই মহানায়কের গন্ধ নিতে চান। ৭১’র ৬ ডিসেম্বর চিরদিনের জন্য বিধবা হওয়ার লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়ে মরার আগে একটু হালকা হতে চান নুরূল আক্তার। চোখের সামনে স্বামী ও দেবরের রক্ত কিভাবে ভেসে গিয়েছিল? কিভাবে ৪ শিশুকে নিয়ে ১৮০০০ দিন পার করেছেন? তা শুধু জননেত্রীর সাথে একটু শেয়ার করতে চান। নতুবা মরেও শান্তি পাবে না নুরূল আক্তারের আত্মা। শহীদ বুদ্ধিজীবির বৃদ্ধা স্ত্রী নুরূলের শেষ ইচ্ছাটুকু পূরণ হবে তো?

নূরূল আক্তারের স্মৃতিচারণ: 
বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য বকুল মিয়া ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ ছাত্র সংসদের ছাত্রলীগ মনোনিত জি.এস ছিলেন। পরে পড়া লেখা করে আইন পেশায় নেমে পড়েন। ঢাকা আইনজীবী সমিতির সদস্য থাকাকালে মগবাজার আ.লীগের সহসভাপতি ও বৃহত্তর কুমিল্লা জেলা আ.লীগের সদস্য ছিলেন। ওঁর সিনিয়র ব্যারিষ্টার আমিরূল ইসলাম ও ব্রিটিশ নাগরিক টমাস উইলিয়াম সহ তারা তিন জনে মিলেই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাটি ড্রাফটিং করেছিলেন। মামলা ড্রাফটিং কাজ করাকালে প্রায়ই রাত গভীর হয়ে যেত। একদিন অনেক রাত হয়ে গেছে। বকুল মিয়া টেনশন করছিলেন। ব্যারিষ্টার আমিরূল ইসলাম বকুল মিয়াকে বলেন, চিন্তা করিও না। তোমাকে গাড়ি দিয়ে বাসায় দিয়ে আসব। এভাবে প্রায়ই উনাকে (বকুল মিয়াকে) বাসায় দিয়ে যেতেন। ১৯৭১ সাল। বঙ্গবন্ধুর ডাকে শুরূ হয়ে যায় স্বাধীনতা যুদ্ধ। স্বামী বকুল মিয়ার খাওয়া ঘুম নেই। মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতায় কোমর বেঁধে নেমে পড়েন। একসময় ঢাকা থেকে পরিবার সহ গ্রামের বাড়িতে চলে আসেন। দেবর আফজাল ও চলে যায় যুদ্ধে। চারিদিকে তুমুল যুদ্ধ। পাকবাহিনী ও এ দেশীয় রাজাকারদের দাপট। দুই ভাই চলে যান যুদ্ধে। ১ ছেলে ও ২ কন্যাশিশু সন্তান নিয়ে আতঙ্ক উৎকন্ঠার মধ্যে সময় পার করেন নুরূল। এক ফাঁকে বাড়িতে আসেন তারা। ৪ ডিসেম্বর সকাল বেলা।  কোরআন তেলাওয়াত করছেন বকুল মিয়া। হাজির পাকবাহিনী। স্ত্রী স্বজনদের সামনে চোখ বেঁধে নিয়ে যান তাকে। পরের দিন ছোট ভাই মুক্তিযোদ্ধা আফজাল হোসেনকে আটক করেন। দুজনই নিখোঁজ। ৪ দিন পর কুরূলিয়ার খাল পাড়ে মিলে দুই ভাইয়ের লাশ। বড়ই নির্মম! তাদের বুক পেট বুলেটের আঘাতে ঝাঁঝড়া। ক্ষত বিক্ষত। লাশ গুলো দিতে চাইনি পাক সেনারা। অনেক অনুরোধের পর মন গলে বর্বরদের। ১০ ডিসেম্বর তাদের লাশ আনা হয়। স্বজনদের আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠে গোটা সরাইলের পরিবেশ। পিতার লাশের পাশে নির্বাক দাঁড়িয়ে শিশু রূমী (০৮), রূবী (০৭) ও একমাত্র শিশুপুত্র কাউছার (০৬)। মাত্র ২৫ বছর বয়সে বিধবার শাড়ি পড়ে মূর্চ্ছা যাচ্ছিলেন নুরূল। আর্থিক সংকটে পড়ে যায় গোটা পরিবারটি। সন্তানদের জীবন বাঁচানোর যুদ্ধে নেমে পড়েন নুরূল। বকুল মিয়ার মৃত্যুর ২ মাস পর জন্ম গ্রহন করে আরেক মেয়ে সৈয়দা ফারজানা খানম। কষ্টের দিন পার করতে থাকেন তারা। এভাবেই পার করেছেন ৫০টি বছর। এ যুদ্ধে জয়ী হয়েছেন তিনি। তার ৪ বছরের শিশু কাউছার এখন পিতার আদর্শে যোগ্য উত্তরসূরী। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জজ কোর্টের একজন খ্যাতিমান উকিল। তিনি আওয়ামী রাজনীতির সাথে সক্রিয় ভাবে জড়িত। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে দলীয় মনোনয়ন যুদ্ধেও লড়াই করেছেন তিনি। দলীয় সিদ্ধান্তের বাহিরে কখনো যান না শহীদ বুদ্ধিজীবির সন্তান কাউছার। নুরূল আক্তার বলেন, রাষ্টের কাছ থেকে এখন পর্যন্ত আর্থিক কোন সুবিধা পায়নি। তবে পেয়েছি সম্মান। ১৯৯২ সালে ঢাকা বার সমিতির মূল ফটকের সামনে ‘হৃদয়ে বাংলাদেশ’ নামের স্মৃতিফলকে ৬ জন শহীদ আইনজীবির নামের সাথে বকুল মিয়ার নাম রয়েছে। এ ছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া কাউতলীর গোল চক্করে ‘সৌধ হিরন্ময়’ সৌধে ওঁর নাম আছে। ১৯৯৮ সালে শহীদ বুদ্ধিজীবি সৈয়দ আকবর হোসেনের নামে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ কর্তৃক “শহীদ বুদ্ধিজীবি স্মারক ডাক টিকেট” উম্মোচন করেছেন। সম্প্রতি রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে শহীদ ১৯১ জন বুদ্ধিজীবীর গেজেট হয়েছে। সেখানে আকবর হোসেনর নাম স্থান পেয়েছে। এখন বছর ঘুরে ৬ ডিসেম্বর আসলেই স্বামী হারানোর বেদনায় কলিজা ছিঁড়ে যেতে চায়। নীরবে শুধু চোখের জলে ভাসী। 

দেখেছি বঙ্গবন্ধুকে:
ঘটনাটি ১৯৭২ সালের শেষের দিকের। বঙ্গবন্ধু আমাকে টাকা আনতে খবর দেন। আমার মামা শামাইন চৌধুরী আমাকে নিয়ে যান গণভবনে। সেখানে অবস্থান করছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মহিউদ্দিন ছিলেন শেখ সাহেবের বডিগার্ড। গেইটে যাওয়ার পর আমাকে আটকে দেয়। তারা জিজ্ঞেস করেন- আপনি কে? আমি বললাম বকুল সাহেবের স্ত্রী। দ্রƒত গেইটটি খুলে দেন। আমি ভেতরে প্রবেশ করি। ভেতরে গিয়েই শুনতে পাই বঙ্গবন্ধু বলছেন-‘ সবাই তো আসল, কিন্তু বকুলের কেউ যে আসল না?’ আমি পরিচয় দেয়। বঙ্গবন্ধু আমার হাতে দুই হাজার টাকার একটি চেক দিয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে বলেন, মা চিন্তা করিও না আবারও টাকা দিব। নুরূল আক্তার বলেন, বয়স অনেক। যে কোন সময় মারা যেতে পারি। মারা যাওয়ার আগে একবার জাতীর জনকের কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার সাথে সাক্ষাৎ করতে চাই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার বিনীত অনুরোধ আমি বৃদ্ধাকে একটু সুযোগ দেন। নতুবা স্বামী হারানোর মত আরেকটি শোক নিয়েই কবরে যেতে হবে।

বুদ্ধিজীবী দিবস পালনের সভায় দাবী:
গত ৭ ডিসেম্বর সরাইলে অনুষ্ঠিত হয়েছে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালনের প্রস্তুতি সভা। সভায় সরাইল মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ বদর উদ্দিন ও প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মাহবুব খান বলেন, সরাইলে এখন পর্যন্ত একমাত্র সৈয়দ আকবর হোসেন-ই শহীদ বুদ্ধিজীবী। জাতিকে মেধা শুন্য করার জন্য পাকবাহিনী এ হত্যাকান্ড ঘটিয়েছিল। এ বছরের ২৭ মে গেজেট শাখার উপসচিব রথিন্দ্র নাথ দত্ত স্বাক্ষরিত ১৯১ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর চুড়ান্ত তালিকা প্রকাশিত হয়েছে। স্বাধীনতান ৫১ বছর পরও স্থানীয় ও সরকারি ভাবে প্রয়াত আকবর হোসের স্মৃতিকে ধরে রাখার কোন ব্যবস্থা হয়নি। দেশের জন্য যিনি নিজের জীবনটা বিলিয়ে দিলেন তার জন্য কি আমাদের কিছুই করার নেই? আগামী ১৪ ডিসেম্বর ওঁর সমাধিস্থলে যথাযথ ভাবে সম্মান প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হউক। আকবর হোসেনের স্মৃতি ও বীরত্বগাঁথা ইতিহাস আগামী প্রজন্মকে দেশ প্রেমে উজ্জীবিত করবে। তাই উপজেলা চত্বরে, প্রত্যেকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, ইউনিয়ন অফিসে ওঁর নামের স্মৃতি স্তম্ভ করার ব্যবস্থা করা হউক।  

এফএনএস